কান্দাহার ঘিরে ফেলেছে তালিবান। আর এজন্য তালিবানদের হাত থেকে বাঁচতে আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে ভয়ে পালাচ্ছে মানুষ। দেশটির কর্মকর্তাদের মারফত জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে দেড় লাখের বেশি মানুষ। তবে শুধু কান্দাহার না, দেশ ত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে অধিকাংশ মানুষ।
এদিকে, কান্দাহারের ৪টি জেলায় যুদ্ধ চলছে আফগান বাহিনী ও তালিবানের। তারা বেশিরভাগ ভবন দখল করে যুদ্ধ চালাচ্ছে। সংঘর্ষের সময় বেছে নেয়া হচ্ছে বাড়ির ছাদও। এর মধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে রাজধানী কাবুলের চারপাশে শরণার্থী শিবির তৈরি করা হয়েছে। কান্দাহার ও অন্যান্য তালিবান অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে সাধারণ মানুষ এই সব শরণার্থী শিবিরেই আশ্রয় নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি মানুষ ঠাঁই নিয়েছে এসব শিবিরে।
বাস্তুচ্যুত প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার মানুষ
কান্দাহার ছেড়ে বহু মানুষ পালিয়ে যাচ্ছেন। এখনো কাবুল যাওয়া যাচ্ছে বিমানে। বহু মানুষ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। কারণ স্থলপথ বন্ধ। গোটা কান্দাহার ঘিরে ফেলেছে তালিবান।
কান্দাহারের বাসিন্দা কায়সার সামা তালিবানের ভয়ে পরিবারসহ পালিয়ে গেছেন রাজধানী কাবুলে। আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার প্রায় দখলে নিয়েছে তালিবান। ফলে সেখানে বসবাস করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ছাড়া মার্কেটে যাওয়া বিপদ। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ। বলা যায়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা থেমে গেছে সেখানে।’
২৩ বছর বয়সী আরেক বাসিন্দা নাভিদ আমিনি বলেন, তিনি জন্মের পর থেকে কান্দাহারে বসবাস করছেন কিন্তু এমন ভয়ানক পরিস্থিতি আর কখনো দেখেননি কয়েক সপ্তাহ ধরে যা ঘটছে। তালিবান পুরো এলাকা জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কান্দাহার থেকে আল জাজিরাকে ফোনে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন, শহরের চারপাশে এখন যুদ্ধ চলছে।
আফগানিস্তানের প্রাদেশিক শরণার্থী অধিদপ্তরের প্রধান দোস্ত মোহাম্মদ দারিয়াব বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের সাম্প্রতিক লড়াই গত এক মাসে কান্দাহারের ২২ হাজার পরিবারকে ঘরছাড়া করেছে। বাস্তুচ্যুত প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার মানুষের জন্য চারটি ক্যাম্প নির্মাণ করেছে কান্দাহারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
কান্দাহার প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর লালাই দস্তগিরি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর গাফিলতির (বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী) কারণে কান্দাহারের এত কাছে আসতে পেরেছে তালিবান। তিনি বলেন, আমরা এখন আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সংগঠিত করার চেষ্টা করছি।
সাধারণ মানুষও তালিবানের শিকার
সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, তালিবান সাধারণ মানুষকেও আক্রমণ করছে। প্রকাশ্য রাস্তায় তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এখুনি এ ঘটনা বন্ধ হওয়া দরকার।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, সরকারি কর্মী অথবা সরকারের কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালাচ্ছে তালিবান। তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। জাতিসংঘও সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। যেখানে সবপক্ষকেই মানবাধিকারের কথা মাথায় রাখতে বলা হয়েছে।
যদিও তালিবান অবশ্য এ কথা মানতে রাজি হয়নি। তাদের বক্তব্য, যাবতীয় মানবাধিকার মেনেই তারা লড়াই করছে। কান্দাহারে সাংবাদিকদের একটি দল নিয়ে গিয়ে তারা পরিস্থিতি দেখাবে বলে জানিয়েছেন তালিবান মুখপাত্র। তার দাবি, ইসলামের আইন মেনেই তারা কান্দাহারে লড়াই করছেন।
এদিকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে কান্দাহারে আটক করেছে আফগান সরকার। অভিযোগ, টেলিভিশন এবং রেডিও-র ওই সাংবাদিকরা প্রোপাগান্ডা ছড়াতে সেখানে গিয়েছিলেন। অ্যামনেস্টি দ্রুত ওই সাংবাদিকদের রেহাইয়ের ব্যবস্থা করতে বলেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সাংবাদিকদের ছাড়ার ব্যাপারে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
আফগান সরকারি বাহিনী ও তালিবানের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গোলাগুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার সংখ্যা আরও বেড়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ‘২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে বিস্ফোরক হামলায় ৫০১ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছন এক হাজার চারশো ৫৭ জন।’
উল্লেখ্য, ৬ লাখ ৫০ হাজার জনগোষ্ঠী নিয়ে কান্দাহার আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকার সময় দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ কান্দাহার ছিল তালিবানের শাসনের কেন্দ্রস্থল।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলা চালানো জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে তালিবানের সম্পর্কের জেরে আফগানিস্তানে ওই বছরই সামরিক অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত অভিযানে ওই বছরই আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে তালিবানকে উৎখাত করা হয়।
তালিবানের ভয়ে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি
গত কয়েক দিন থেকেই হাজারো মানুষের ভিড় জমছে কাবুলের পাসপোর্ট অফিসে। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। করোনাকে তুচ্ছ করে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়াচ্ছেন লাইনে। একেক জানালায় এক একটা লাইন। বেলা বাড়ছে, লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। শুধু তালিবানদের কুশাসন আতঙ্কই নয়, এরই মধ্যে খরা ও খাদ্য সংকটে ধুঁকতে শুরু করেছে দেশটির প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
এএফপি প্রতিবেদক জানিয়েছেন, অধিকাংশ দিনই ভোর হওয়ার আগে ডজন ডজন লোক পাসপোর্ট অফিসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই লাইন ১০০ মিটারেরও বেশি দীর্ঘ হয়। পাসপোর্ট অফিসের সামনে কর্তব্যরত এক পুলিশ জানিয়েছেন প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার লোক এই পাসপোর্ট অফিসের সামনে ভিড় করেন।
তালিবান-সন্ত্রাসের চেহারা মনে করতেই শিউরে ওঠা কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী জিনাত বাহার নাজারি (২৩) বলেন, ‘আমরা যখন শিশু ছিলাম, আমাদের পরিবারের কাছে তখন শুনেছি, তালিবানরা মানুষ হত্যা করছে, অনেক মানুষ গুম হয়ে যান। তারা মহিলাদের প্রতি সহিংস ছিল, মহিলার শিক্ষায় এগিয়ে যাক এটা তারা চাইত না। এমনকি নারীদের মৌলিক অধিকার কিংবা মানবাধিকারের প্রতিও তারা হুমকি হয়ে ছিল। তালিবান বলতে আমরা বুঝি, সন্ত্রাস-লড়াই, আত্মঘাতী বোমা হামলা আর কেবলই রক্তপাত। ওরাই যদি আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে আমরা এদেশে থাকব কীভাবে?’
বিদেশি সৈন্যরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় মূলত নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে শুরু করেছেন আফগান নাগরিকরা। তালিবানরা দখল করে নিয়েছে দেশটির অধিকাংশ এলাকা। এ অবস্থায় জীবনশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন হাজারো আফগান নারী-পুরুষ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই দেশ ছাড়তে চান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৬
আপনার মতামত জানানঃ