এবার কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নে পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৫ জন নিহত হয়েছে। এরা সবাই শিশু। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসের এই ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনা নিশ্চিত করে টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী বলছেন, বুধবার ভোররাত একটা থেকে দুইটার মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। হ্নীলা ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডে বসবাসকারী ওই পরিবারের শুধু বাবা-মা জীবিত আছেন এখন।
পারভেজ চৌধুরী বলেন, ওই এলাকায় টানা কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় আশপাশের বাসিন্দাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যে পরিবারের ৫ শিশু নিহত হয়েছে তাদেরকেও আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল কিন্তু তারা রাজি হয়নি। তাদের পরিবারকেও স্বেচ্ছাসেবীরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাজি হয়নি। এটাই দুঃখজনক।
পারভেজ চৌধুরী বলেন, পাহাড় ধসের আশংকায় এরইমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে ছয় থেকে সাতশ মানুষ রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেককেই জোর করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
তার মতে, টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। স্থানীয়দের এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও তাদের অনেক সময় আশ্রয় কেন্দ্রে আনা সম্ভব হয় না।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে পাহাড়ধসে ও পানিতে ভেসে ছয় রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নিহতদের অনেকেই শিশু। এর মধ্যে বালুখালী ক্যাম্প-১০-এ পাহাড়ধসে মারা গেছে পাঁচজন। এ ঘটনায় আরও অনেকে আহত হয়েছে। আর পালংখালী ক্যাম্প-১৮-তে পানিতে ভেসে গেছে এক রোহিঙ্গা শিশু।
কেন ঝুঁকিতে থাকলেও, ঘর ছাড়ছে না মানুষ?
এদিকে, যারা প্রাকৃতিক দুযোর্গ এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকা নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তারা বলছেন বাংলাদেশে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঝড় বা বন্যার ইতিহাস দীর্ঘ এবং এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু পাহাড় ধস মানুষের কাছে ততটা পরিচিত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সটিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ভালনারেবিলিটি এর পরিচালক-অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলছেন ২০০৭ সালের আগে পাহাড় ধসে প্রানহানীর ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। তাই এই ধসে প্রাণ যেতে পারে সে সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা গড়ে উঠেনি এখনো।
মাহবুবা নাসরিন বলছেন, বিশেষ করে তিন পার্বত্য এলাকার মানুষের মধ্যে বসতভিটা দখল হয়ে যাওয়ার একটা ভয় তাদের কাজ করে। সেকারণে ঝুঁকি থাকলেও হয়তো অনেকে বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন না।
কেন বারবার ঘটছে পাহাড়ধস?
কক্সবাজারে বর্তমানে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে যাদের পাহাড়-ধসের শিকার হওয়ার উদ্বেগ রয়েছে । কিন্তু এর বাইরেও প্রায় আড়াই লক্ষ পরিবার যারা স্থানীয় বাসিন্দা, তাদেরও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিধসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া অফিস বলছে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টি চলবে, অর্থাৎ এখনো দুমাসেরও বেশি বর্ষাকাল স্থায়ী হবে। কক্সবাজারের গত কয়েকদিন ধরেই টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যার ফলে পাহাড়ের পাদদেশে বাস করা এসব মানুষের জীবন আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বেসরকারি একটি সংস্থা জেলা উপকূলীয় পল্লী উন্নয়ন পরিষদ বলছে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় আড়াই লাখ পরিবার পাহাড়-ধসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী প্রধান নুরুল আমিন সিদ্দিক বলছিলেন কক্সবাজারের আটটি উপজেলায় এই ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার সদর, রামু, চকোরিয়া, পেকুয়া এসব এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা এই কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় প্রায় এক বছর ধরে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে। যাদের আশ্রয়ের দেয়ার জন্য অনেক পাহাড় কাটা হয়েছে ঐ এলাকায়। আবার একই সাথে কিছু কিছু মানুষ টিলা বা পাহাড়ের পাদদেশে বাস করছে এখনো। তাদের ভূমিধসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বরাবরই করা হচ্ছে।
পাহাড় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন এবং বন-জঙ্গল ও গাছ উজাড়ের কারণেই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।
দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল এবং গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন শক্ত রাখে। কিন্তু লোভী মানুষরা অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটছে। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষ বসতির প্রয়োজনেও পাহাড় কাটছে। এতেই পাহাড় ধ্বংসের পথ তৈরি হয়।
এ ছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে চলতি বছরে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বেশ কয়েকটি পাহাড় ইতিমধ্যে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ