সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে চীন রাশিয়া ও বাংলাদেশ। মাধ্যমগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশগুলোর সরকার। ইতোমধ্যে চীন রাশিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাগাম ধরতে আইনও ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশেও হতে যাচ্ছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। একইসাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিকল্প মাধ্যম তৈরীরও ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
ডিজিটাল মাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চীন-হংকং
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল মাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে হংকং। চীনের অধীনে স্বায়ত্ত্বশাসনে থাকা হংকং, চীনের জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করতে যাচ্ছে নিজ অংশেও।
চলতি মাসের শুরুর দিকে হংকং-এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন কার্যকর করা হয়। এই আইনের আওতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মাধ্যমগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না।
কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আইন ভঙ্গ করে কোনো প্ল্যাটফর্ম কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শারীরিক বা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যদি তথ্য প্রকাশ করে তাহলে উক্ত প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ এক বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ এক লক্ষ ২৮ হাজার ৭৩১ মার্কিন ডলার পর্যন্ত আর্থিক জরিমানার সাজা ঘোষণা করা যাবে।
অবশ্য আইনের কঠোরতা কমিয়ে আনতে হংকং সরকারের কাছে জোটবদ্ধভাবে আবেদন জানিয়েছে গুগল, ফেসবুক, টুইটার, অ্যাপল এবং লিঙ্কড ইন। তবে সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন হংকং সরকারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যারি ল্যাম।
এবিষয়ে ক্যারি ল্যাম বলেন, এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা অবৈধভাবে তথ্য প্রকাশ করে বা ব্যবহারকারীদের তথ্যের অনৈতিক ব্যবহার করে সেগুলোকে বন্ধ করা। একইসঙ্গে গোপনীয়তা বিষয়ক কমিশনের কমিশনারেরা যেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে তথা তদন্ত করতে পারে সেই পথ নিশ্চিত করা। এই আইন দ্রুত প্রয়োগ করা হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সাল থেকে চীনের মূল ভূখণ্ডে গুগল, ফেসবুক ও অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান ও সেগুলোর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সেবা বন্ধ রয়েছে। তবে হংকং-এ এখনও এসব কোম্পানি চালু রয়েছে এবং তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে ২০১৯ সালে হংকং-এর সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার পেছনে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দায়ী করে আসছে চীন।
মূলত এরপর থেকেই হংকং-এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসে বেইজিং যার সর্বশেষ ফলাফল নতুন এই আইন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রাশিয়া
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিল রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রাশিয়ার স্থানীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় বলে অভিযোগ দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের।
আসছে জানুয়ারিতে এসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে পাস হওয়া আইন কার্যকর করতে যাচ্ছে পুতিন প্রশাসন।
চলতি মাসের শুরুর দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন পাস করে রাশিয়া। এই আইনের আওতায়, দেশটিতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ সদস্য আছে এমন প্ল্যাটফর্মকে নির্দিষ্ট কিছু বিধিবিধান মানতে হবে।
এসব বিধানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রাশিয়ায় সেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সরাসরি অফিস বা শাখা অফিস খুলতে হবে। দেশটির নিজস্ব আইন অনুযায়ী, সেই অফিসের নিতে হবে অনুমোদন। বিজ্ঞাপন থেকে আয় করা অর্থের একটি অংশ কর আকারেও প্রদান করতে হবে রুশ সরকারকে।
আগামী বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই আইন কার্যকর হবে। আর এর মাঝের সময়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে এসব আইন বাস্তবায়নে বা আইন মেনে চলতে যা যা দরকার সেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। এমনটা না হলে সেদিনই রাশিয়ায় বন্ধ করে দেওয়া হবে সেসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রম।
অবশ্য কারও প্রতিই কঠোর কিছু আসবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, কাউকেই বন্ধ করার কোনও ইচ্ছা নেই আমাদের বরং তাদের সঙ্গে মিলে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যখন তারা আমাদের শর্তগুলো মানতে পারে না এবং রাশিয়ান আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারে না তখন তারা আমাদের দূরে ঠেলে দেয়।
পুতিন আরও বলেন, যদি তারা আমাদের দেশে কার্যক্রম করতে চায়, অর্থ আয় করতে চায় তাহলে তাদের আমাদের আইন মানতেই হবে।
বর্তমানে দেশটিতে গুগলের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত চলমান আছে। রাশিয়ান ব্যবহারকারীদের তথ্য রাশিয়ার বাইরে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ব্যবহারকারীদের তথ্য রাশিয়ান সার্ভারেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এমনটা প্রমাণ করতে না পারলে গুগলের বিরুদ্ধে ৮২ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করতে পারে রুশ প্রশাসন।
এছাড়াও দেশটির আইন না মানায় বেশকিছু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বন্ধ থাকার নজিরও রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ডেইলি মোশন এবং পেশাজীবীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংকড ইন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাগাম টানতে যাচ্ছে বাংলাদেশ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাগাম টানতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। গুজব ও রাষ্ট্র বিরোধী প্রচারণা ও নানা বিধ সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এই আইন তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
এছাড়াও এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে বলেও জানান তিনি। তবে এই আইনের মাধ্যমে বাক স্বাধীনতাকে খর্ব না করে জনকল্যাণের জন্য ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর লাগাম টানতে ডেটা প্রাইভেসি আইন করতে যাচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ।
গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ডেটা অফিস দেশে প্রতিষ্ঠা করা, জবাবদিহিতা ও তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিদেশের মাটিতে থাকা অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনাসহ থাকছে আরও কঠোর আইন।
জনগনের বাক-স্বাধীনতাকে ঠিক রেখে এমন আইন করা গেলে দেশের,মানুষের সাইবার জগৎ আরও নিরাপদ হবে বলে মনে করেন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে ডেটা প্রাইভেসি আইনের খসড়া। যা অনুমোদন পেলেই জবাবদিহিতার আওতায় আসবে লাগামহীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে দেশকে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষে আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে ফেসবুকের বিকল্প নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের উদ্যোগে নির্মাণাধীন প্ল্যাটফর্মটির নাম দেওয়া হচ্ছে ‘যোগাযোগ’। এর মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তারা তথ্য-উপাত্ত ও যোগাযোগের জন্য নিজস্ব অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও গ্রুপ তৈরি করতে পারবে। উদ্যোক্তাদের বিদেশনির্ভর হতে হবে না। গত শনিবার এসব কথা বলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ।
কেবল ফেসবুকের বিকল্প নয়, জুনাইদ আহমেদ বলেন, নিজস্ব যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপের বিকল্প হিসেবে ‘আলাপন’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হচ্ছে।
আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে ভিডিও কনফারেন্সের প্ল্যাটফর্ম জুমের বিকল্প ‘বৈঠক’ তৈরি করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। এ ছাড়া করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সুরক্ষা অ্যাপের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
পাশাপাশি স্ট্রিমিংসহ নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির কার্যক্রমের বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ