কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। করোনায় বড়দের মতোই শিশুদের জীবনেও অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। হাম, পোলিও, ডিফথেরিয়া, টিটেনাসের মতো ভয়াবহ রোগগুলোর টিকা সময়মতো না পাওয়ায় ঝুকিঁতে বিশ্বের সোয়া দুই কোটির বেশি শিশুর জীবন।
গতকাল বৃহস্পতিবার(১৫ জুলাই) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের ১০টি দেশে ২ কোটি ২৭ লাখ শিশু গত বছর হাম, পোলিও, ডিফথেরিয়া, টিটেনাসের মতো প্রচলিত রোগের টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৩৭ লাখ বেশি। ২০০৯ সালের পর থেকে গত বছরই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশু টিকাবঞ্চিত হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ করোনা মহামারি।
ইউনিসেফের টিকাদানবিয়ষক প্রধান এফ্রেম লেমাঙ্গো বলেছেন, টিকার একটি ডোজও না পাওয়া শিশুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর এক ডোজ টিকাও পায়নি বিশ্বের প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ শিশু; যা ২০১৯ সালে ছিল এক কোটি ৩৬ লাখ। এই শিশুদের অনেকেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ অথবা বস্তিগুলোতে বসবাস করছে।
গত বছর বিশ্বের ২ কোটি ২৩ লাখ শিশু হামের টিকার প্রথম ডোজ পায়নি বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। এর ফলে আফগানিস্তান, মালি, সোমালিয়া, ইয়েমেনের হাসপাতালগুলোয় হামে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ সময় বিশ্বজুড়ে ৬৬টি দেশ করোনা সংক্রমণ, লকডাউনের কারণে শিশুদের জন্য পরিচালিত অন্তত একটি টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
শিশুদের সংক্রামক রোগগুলোর অন্যতম হলো হাম। তুলনামূলক দুর্বল স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় হামে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা মারা যায়। পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে যায় শিশুরা।
ভারত, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের ১০টি দেশে ২ কোটি ২৭ লাখ শিশু গত বছর হাম, পোলিও, ডিফথেরিয়া, টিটেনাসের মতো প্রচলিত রোগের টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৩৭ লাখ বেশি। ২০০৯ সালের পর থেকে গত বছরই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশু টিকাবঞ্চিত হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ করোনা মহামারি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির মধ্যে নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমে ঘাটতি শিশুদের প্রাণঘাতী রোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে। টিকাদানের বৈশ্বিক অর্জনগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বিশ্বের অন্যতম সংক্রামক রোগ হাম পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য— বিশেষ করে আফ্রিকান ও এশিয়ার দেশগুলোর দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে প্রাণবিনাশী হতে পারে। পোলিওতে আক্রান্ত শিশু সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
এই বিষয়ে ডব্লিউএইচওর টিকাদানবিষয়ক পরিচালক কেট ও’ ব্রায়েন বলেন, ‘করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে শিশুদের টিকাদানে এই ব্যর্থতা আমাদের এক দশকের বেশি পিছিয়ে দিয়েছে।’
ও’ব্রায়েন বলেছেন, চলতি বছর আমাদের সম্ভাব্য এক নিখুঁত ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা সেই নির্ভুল ঝড়কে আঘাত হানতে দিতে চাই না। আমরা সেই সঙ্কেত এখন বাজাতে চাই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন কোভিডের-১৯ এর ভ্যাকসিনের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। এর কারণে আমরা অন্যান্য ভ্যাকসিন থেকে পিছিয়ে পড়ছি। ফলে শিশুরা হাম, পোলিওসহ বিভিন্ন মারাত্মক কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য রোগের ঝুঁকিতে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘টিকা না পেলে বিভিন্ন রোগ মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। স্বাস্থ্য সেবাদানকারীরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। শিশুদের টিকার জন্য বিনিয়োগ খুব জরুরি এবং সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে।’
করোনার বিপর্যয়ে কোটি শিশুর অধিকার ঝুঁকিতে
এর আগে গত মাসে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংগঠন তাদের বার্ষিক জরিপে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়ে শিশুদের অধিকারের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারগুলো পদক্ষেপ না নিলে এই শিশুরা ‘এক প্রজন্মের বিপর্যয়ের’ শিকার হতে পারে। জরিপটি পরিচালনা করেছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও কিডসরাইটস।
কিডসরাইটসের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে গৃহীত নানা বিধিনিষেধের কারণে বিশ্বে কোটি কোটি শিশু শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
কিডসরাইটসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মার্ক ডুলেয়ার্ট বলেন, করোনা মহামারি শিশুদের ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তা আমাদের অনুমান ছাড়িয়ে গেছে।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাইরে করোনা মহামারিতে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তারা হলো শিশুরা। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা যে শুধু প্রত্যক্ষভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়; বরং তাদের অধিকার সুরক্ষায় সরকারগুলোর বিলম্বিত পদক্ষেপেও পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে।
মার্ক ডুলেয়ার্ট বলেন, শিশুদের মধ্যে প্রজন্মগত বিপর্যয় এড়াতে হলে তাদের শিক্ষালাভের সুযোগ ফিরিয়ে দিতে হবে।
কিডসরাইটস বলছে, বিশ্বে ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশুশিক্ষার্থী এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলে যেতে পারছে না। এর মধ্যে এক–তৃতীয়াংশ শিশুর দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই। আবার, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মহামারির ধাক্কা লাগায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের উপকরণগত ঘাটতিতে পড়েছে বাড়তি ১৪ কোটি ২০ লাখ শিশু। স্কুল থেকে সরবরাহ করা খাবার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে ৩৭ কোটি শিশু।
কিডসরাইটস আরও বলেছে, করোনায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় এক বছরের কম বয়সী আট কোটি শিশু এরই মধ্যে বিভিন্ন রোগের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির বাইরে থেকে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লকডাউন পরিস্থিতিতে পারিবারিক নির্যাতন ‘বিস্ময়করভাবে বেড়ে’ গেছে, অনেক সময় এমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ