চীন ১৯৬৪ সালেই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, সেখানে ভারত পারমাণবিক শক্তিধর হয় ১৯৯৮ সালে। এই দুই এশিয়ান জায়েন্টের টানাপোড়েন বেশ পুরনো। তবে গত ৪ দশক ধরে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেলেও, গত এক বছর ধরে এই সম্পর্ক নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর বর্তমান আফগানিস্তান পরিস্থিতির কাঁধে বন্দুক রেখে ভারত শিকারের পরিকল্পনায় ব্যস্ত চীন-পাকিস্তান জুটিতে বেশ চিন্তায় আছে মোদি সরকার। আর তাই চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসলো ভারত।
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের বৈঠকে যোগ দিয়ে গতকাল বুধবার দুশানবে’তে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হন জয়শঙ্কর। সেখানে দু’নেতার মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আউটলুক ইন্ডিয়া।
এতে আরো বলা হয়, তারা লাদাখ এবং ভারত-চীন সম্পর্কের বিস্তারিত দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেন। তবে সীমান্ত এলাকায় নিষ্ক্রিয়তা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য চীনের তাড়াহুড়ো নেই বলেই মনে হয়েছে। আর চীনের এই প্রবণতার প্রতি ভারতের হতাশা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাঙ্গোং সো এলাকায় উভয় পক্ষ নিষ্ক্রিয় বা নীরব থাকার পর থেকেই অন্য এলাকাগুলো থেকে সরে যেতে গড়িমসি করছে চীন। এমনকি লাদাখ পরিস্থিতি ভারত ও চীনের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, এমনটাই বলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
গত বছর জুন মাসে ভারত-চীন সীমান্তের লাদাখে তীব্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে দুই দেশের সেনা। ভারতের প্রায় ২০ জন সেনা নিহত হন। চীন সংখ্যা না জানালেও তাদের সেনাও আহত এবং নিহত হওয়ার খবর মিলেছে।
এরপর প্রায় নয় মাস ধরে লাদাখ সীমান্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে দুই দেশের সেনা। গালওয়ান ছাড়াও প্যাংগং লেক অঞ্চলে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। পাশাপাশি ভারত চীনের বিরুদ্ধে এবং চীন ভারতের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তোলে।
সেনা পর্যায়ে একাধিক আলোচনা এবং দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর সমাধানসূত্র বের হয়। দুই দেশই ঠিক করে প্যাংগং অঞ্চল থেকে সেনা পিছিয়ে নেয়া হবে। গত কয়েক মাস ধরে সে কাজ চলেছে। উত্তাপও খানিকটা কমেছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়নি।
প্যাংগং অঞ্চল থেকে সেনা সরলেও অন্যান্য বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চলে এখনো সেনা দাঁড়িয়ে আছে। দুই দেশই আধুনিক সমরাস্ত্র মজুত করে রেখেছে প্রকৃত সীমান্তরেখার অদূরে। বুধবার এই বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই স্থির করেছেন, দ্রুত সেনা পর্যায়ের বৈঠকের মাধ্যমে এর সমাধানসূত্র খুঁজতে হবে। বৈঠকের পর চীনের মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি পোস্ট করেন জয়শংকর।
বৈঠক শেষে এস জয়শঙ্কর টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘দুশানবে এসসিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের পাশাপাশি চীনের স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংইর সঙ্গে এক ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষ হলো। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার পাশের অঞ্চলের বকেয়া ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর টুইটে বলা হয়েছে, ‘সীমান্তে একতরফা স্থিতাবস্থা পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়, এটা নির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের সম্পর্কের বিকাশের জন্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পুরনো ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনরুদ্ধার এবং শান্তিপূর্ণ স্থিতি রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। সিনিয়র মিলিটারি কমান্ডারদের প্রাথমিক বৈঠক আহ্বান করার বিষয়ে আমরা একমত পোষণ করছি।’
জানা যায়, ভারতের চাইছে গত বছরের এপ্রিলের আগে দুই দেশের সেনার সীমান্তে যে অবস্থান ছিল, সেখানে ফিরে যেতে হবে। প্যাংগংয়ের মতো অন্য বিতর্কিত অঞ্চল থেকেও সেনা পিছিয়ে নিতে হবে।
ভারতীয় কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, চীন তাতে রাজি নয়। এবং সে কারণেই সমাধানসূত্র মিলছে না। তাদের বক্তব্য, বুধবারের বৈঠকেও দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভবত সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাননি। সে কারণেই নতুন করে সেনা স্তরের বৈঠকের কথা বলা হয়েছে।
তবে দুই দেশের মন্ত্রীই একটি বিষয়ে সহমত হয়েছেন, সীমান্তে উত্তেজনার জন্য দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষতি হচ্ছে। দ্রুত তার সমাধান প্রয়োজন।
সূত্র মতে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় এসসিও বৈঠকের সময়েই ভারত-চীনের সীমান্তে দুই দেশের সেনাবাহিনীর উত্তেজনা কমাতে আলোচনায় বসেছিলেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই সময়ে পাঁচ দফা পরিকল্পনা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন তারা।
গত বছরের মে মাসে লাদাখে সংঘাতের পর যাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরেছিল ভারত ও চীন। দ্রুত সেনা সরানো, উত্তেজনা বেড়ে যায় এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে চলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহমত হয়েছিলেন জয়শঙ্কর ও ওয়াং ই।
তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্যানগং লেকের উত্তর ও দক্ষিণ থেকে দুই দেশ সেনা সরালেও হট স্পিং, গোগরা, দেপসাংয়ের মতো কয়েকটি জায়গায় এখনও সমস্যা থেকেই গেছে। এই এলাকাগুলো থেকে চীনা সেনা সরানোর জন্য কমান্ডার পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার জয়শঙ্কর মন্তব্য করেন, আবার অশান্তির সৃষ্টি করতে চাইছে চীন। বেইজিং চুক্তি না মানায় ভারত-চীন সম্পর্কের ওপর তা প্রভাব ফেলছে। গত ৪০ বছর ধরে আমাদের বেইজিংয়ের সাথে বেশ স্থিতিশীল সম্পর্ক ছিল। চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
তবে গত এক বছর ধরে এই সম্পর্ক নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কারণ চীন আমাদের সীমান্তে আসার পরে যে চুক্তিগুলি সই করেছিল তা পালন করেনি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫৪
আপনার মতামত জানানঃ