দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সংক্রমণ পুনরায় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। যা ৫ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
বেবিচকের নিয়ম অনুসারে, ১২টি দেশ থেকে ফিরে এলে ১৪ দিন সরকার নির্ধারিত হোটেলে নিজখরচে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। ফ্লাইটে ওঠার আগেই হোটেল বুকিং করতে হবে। দেশগুলো হলো— আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, জর্জিয়া, কুয়েত, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, উরুগুয়ে। তবে কেউ যদি করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে আসেন, তবে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে না। তিনি বাড়িতে গিয়ে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন। বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনের জন্য ৯৩টি হোটেলকে দেওয়া হয়েছে অনুমোদন।
তবে এ নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্রেফ টাকা নিয়ে যাত্রীদের ছেড়ে দিচ্ছে কোয়ারেন্টিনের জন্য সরকার-নির্ধারিত বেশিরভাগ হোটেল। কোনও হোটেল আবার বিমানবন্দর থেকেই বিদেশফেরতদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ১৪ দিন হোটেল থাকার ভুয়া বিল। নজরদারি না থাকায় বেশিরভাগ হোটেলেই চলছে এমনটা।
বাংলা ট্রিবিউনের এক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরার ১১ নং সেক্টরের গ্র্যান্ড লেক ভিউ হোটেলটিতে একদিনও কোয়ারেন্টিনে থাকা লাগে না বিদেশফেরতদের। যাত্রীদের বিমনবন্দর থেকেই বাড়িতে যাওয়ার ‘ব্যবস্থা’ রেখেছে হোটেলটি।
গ্র্যান্ড লেক ভিউ হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে পাওয়া গেলো মনির হোসেন নামের একজনকে। তিনি বললেন, ‘২১ হাজার টাকা দিয়ে বুকিং দিন, সব ব্যবস্থা করে দেবো।’
আরও বললেন, ‘আপনার যাত্রীকে আমরা ১৪ দিনের হোটেল বুকিংয়ের ডকুমেন্ট বানিয়ে দেবো। সেটা বিমানবন্দরে দেখালে কেউ সন্দেহ করবে না। বিমানবন্দরে থেকেই যাত্রী নিয়ে চলে যেতে পারবেন। আমাদের হোটেলে এখন কোনও গেস্ট নেই, সবাই বাড়িতে।’
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে নামার পর যাত্রীদের হেলথ স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট, হোটেল বুকিংয়ের কাগজপত্র, ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ইত্যাদি চেক করা হয়। যাদের কোয়ারেন্টিন লাগবে না, তাদের এক গেট, যাদের লাগবে তাদের আলাদা গেট দিয়ে বের হতে হয়।
কোয়ারেন্টিন যাত্রীদের পৃথক করার কঠোর ব্যবস্থা না থাকাতেও অনেকে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে মিশে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।
উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে সিটি হোমস। ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের জন্য ২৫ হাজার টাকা নিচ্ছে হোটেলটি। তাদের রিজারভেশনে ফোন করলে জানানো হলো, ২৫ হাজার টাকা বুকিং দিয়ে হোটেলে আসতে হবে। ২-৩ দিন পর ম্যানেজ করে বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে।
বিদেশফেরত এক যাত্রীর স্বজন নূর উদ্দীন ভূইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার পরিচিত একজন জুনে বিদেশ থেকে আসে। তখন তাদের তিনদিন কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা ছিল। দ্য ডেইজ হোটেল বুক করে ঢাকায় আসে তারা। হোটেলে যাওয়ার পর করোনার টেস্ট করাতে তাদের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে বলা হয় আপনারা বাড়িতে চলে যান, হোটেলে থাকা লাগবে না।’
উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরের ব্লু ক্যাসেল হোটেলে দুদিন থাকার পর এক বিদেশফেরত ব্যক্তিকে বাড়িতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। হোটেলটির রিজারভেশনের মো. সিরাজ বলেন, ‘১২ হাজার টাকা দিয়ে বুকিং করেন। তারপর বাকি দায়িত্ব আমাদের। দুই দিন থেকে চলে যেতে পারবেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেক হোটেল যাত্রীদের বাড়ি পাঠাতে বেশ কৌশলী। তারা যাত্রীর পাসপোর্ট হোটেলেই রেখে দেয়। যাতে কোনও সংস্থা অভিযান চালালে তারা পাসপোর্ট দেখিয়ে বলতে পারে, এ যাত্রী হোটেলেই আছেন। মূলত যাত্রী পাসপোর্ট রেখেই চলে যান বাড়িতে। চুক্তি হয়-১৪ দিন পর এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন কিংবা তাকে কুরিয়ার করে সেটা পাঠিয়ে দেবে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া, হোটেল অ্যাফোর্ড ইন, ব্লু ক্যাসেল, হোটেল মিলিনা, মেমেন্টো ইন্টারন্যাশনাল, স্কাই লিংক, লং বিচ, ব্লু বেরি, ক্যানারি পার্কসহ আরও বেশ কিছু হোটেলের বিরুদ্ধেও কোয়ারেন্টিনের নিয়ম না মানার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সুপারিশের ভিত্তিতেই কোন দেশে থেকে আসলে কতদিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে তা নির্ধারণ হয়।
নিদের্শনায় বলা হয়েছে, কোয়ারেন্টিন পালন যথাযথ হচ্ছে কি-না, স্থানীয় প্রশাসন তা নিশ্চিত করবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানা থেকে দায়সারাভাবে মাঝে মাঝে কোনও হোটেলে যায় পুলিশ। তবে স্থানীয় প্রশাসনের কোনও নজরদারি নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরও মনিটিরিং করে না।
অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ বিষয়ে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি। আমাদের লোকজন খোঁজখবর নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কেবিনেটেও জানোনো হয়েছে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাস বিদেশ থেকে আগত এক মহামারি। করোনার উপদ্রবের প্রাথমিক সময়ে বিদেশফেরতদের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে দেশে আমদানিকৃত ভাইরাসটির এহেন বিস্ফোরণ।
তারা মনে করেন, দেশের মানুষের করোনা নিয়ন্ত্রণে নিয়মাবলী মানায় অবহেলা দেখানোতে দেশে ভাইরাসটি যতটা না ছড়িয়ে পড়েছে তারচেয়ে বড় দায় পড়ে বিদেশফেরতদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। বিশেষ করে বর্তমানে ভারতীয় যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি দেশ কাঁপাচ্ছে তার মূলে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যর্থতা। এদিকে সরকার নির্ধারিত বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা থাকলেও সরকারের ও প্রশাসনের গাফিলতি, সঠিক পর্যবেক্ষণের অভাবে দেশে বিদেশফেরতদের করোনা আমদানি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা ব্যর্থ হচ্ছে।
তারা বলেন, ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা থাকলেও কোয়ারেন্টিনের জন্য নির্ধারিত হোটেলগুলোর অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, টাকা নিয়ে একদিনেই রোগী ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি আমাদের মারাত্মকভাবে ভোগাবে। সেটা বেশি দূরেও নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে চলতি মাসই হতে যাচ্ছে দেশের করোনার বিস্ফোরণের মাস।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৬
আপনার মতামত জানানঃ