বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বিভিন্ন দেশে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর প্রভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। জবায়ু পরিবর্তনের সাথে এবার যোগ হয়েছে চাঁদের আকর্ষণ। চাঁদের আকর্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীতে ভয়াবহ নিউইসান্স বন্যার আশঙ্কা করছে বিজ্ঞানীরা। ২০৩০-এর দশকে পৃথিবীজুড়ে রেকর্ড বন্যা হতে পারে বলে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক গবেষণায় উঠে এসেছে মারাত্মক পূর্বাভাস। সূত্র: লাইভ সায়েন্স
উচ্চ জোয়ারের ফলে সৃষ্ট বন্যাকে নিউইসান্স বন্যা বলা হয়। এমন সময়ে, সমুদ্রের তরঙ্গগুলো তাদের গড় উচ্চতা থেকে ২ ফুট বেশি উত্থিত হয়। যার ফলে শহরগুলোতে জল ঢুকতে থাকে। উপকূল এলাকায় ২ ফুট জল বৃদ্ধি আপাতভাবে বেশি মনে না হলেও, এর প্রভাব অপরিসীম। সৈকতসংলগ্ন শহর, গ্রামগুলি এর ফলে প্রভাবিত হয়। এ কারণে পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
নাসার এই সমীক্ষাটি গত মাসে নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জে প্রকাশিত হয়েছিল। নাসার গবেষণা বলছে, আগামী ২০৩০-এর দশকেই এই ‘নিউইসান্স ফ্লাডের’ সংখ্যা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ উপকূলবর্তী এলাকায় এর ফলে জোয়ারের সময়ে জলস্তর ৩-৪ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
সারাবছর ধরেই যে এমনটা চলবে, তা কিন্তু নয়। বছরের কয়েক মাসের মধ্যেই ঘন ঘন এমনটা হবে বলে পূর্বাভাস গবেষকদের।
কারণ যখনই চাঁদের কক্ষপথে সামান্য পরিবর্তন হবে তখনই এই বন্যা আরও ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। উপকূলীয় অঞ্চলে এই বন্যা প্রতি মাসে দু-তিনবার আসবে।
চাঁদের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে উপকূলীয় অঞ্চলে নিউইসান্স বন্যা সেখানে বাসকারী মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এটি এড়াতে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে পরিকল্পনা করতে হবে।
জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডলীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দেওয়া তথ্যানুসারে, ১৮৮০ সাল থেকে সমুদ্রের জলস্তর ৮ থেকে ৯ ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উচ্চতাগুলোর এক তৃতীয়াংশ গত ২৫ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২১০০ সাল নাগাদ, সমুদ্রের স্তর ১২ ইঞ্চি থেকে ৮.২ ফুট পর্যন্ত উঠতে পারে। এটি রোধ করতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে হবে। তবে কয়েক দশক লাগবে এই কাজ শেষ করতে, যা সহজ নয়।
জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডলীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এক নতুন সমীক্ষা অনুসারে, চাঁদ সর্বদা সমুদ্রের তরঙ্গকে প্রভাবিত করে আসছে। চাঁদের টান এবং চাপ উভয়ই বছরের পর বছর ভারসাম্যপূর্ণ রয়েছে। চাঁদ যদি তার কক্ষপথের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে, তবে এটি পৃথিবীর উপকূলীয় অনেক অঞ্চলকে প্লাবিত করবে। কারণ চাঁদ ১৮.৬ বছরে তার জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করে। এই সময়ের মধ্যে অর্ধেক সময় চাঁদ পৃথিবীর ঢেউকে দমন করে। তবে অর্ধেক চক্রের পর চাঁদ তরঙ্গকে তীব্র করে তোলে। তাদের উচ্চতা বৃদ্ধি করে, যা বিপজ্জনক।
নাসা জানিয়েছে যে এখন চাঁদের ১৮.৬ বছরের পূর্ণচক্রের অর্ধেকটি শুরু হতে চলেছে, যা পৃথিবীর তরঙ্গকে ত্বরান্বিত করবে। ২০৩০ সালে এটি ঘটবে। ততক্ষণে বৈশ্বিক সমুদ্রের স্তরটি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এই কারণে বিশ্বের অনেক দেশে নিউইসান্স বন্যার সমস্যা দেখা দেবে। আমেরিকাতে এর চেয়ে আরও বেশি সমস্যা থাকবে। কারণ সে দেশে উপকূলীয় এলাকায় অনেক পর্যটনস্থল রয়েছে।
নাসা বলেছে, জলবায়ু চক্রের এল নিনোর মতো ঘটনাও বন্যার দিকে পরিচালিত করবে। নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী বেন হ্যামলিংটন বলেছেন— এই সমস্ত ঘটনা প্রতি মাসে ঘটবে। এটিও হতে পারে যে বছরের এক অংশে এত বন্যা হবে যে সারা বছর আপনার সমস্যা থাকবে।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফিল থম্পসন বলেছেন, মাসে যদি এইরকম বন্যা ১০-১৫ বার ঘটে তবে মানুষের কাজ কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের আয় ব্যাহত হবে। চাকরি আর থাকবে না। অবিচ্ছিন্ন জলের কারণে মশা বাহিত রোগগুলোও বৃদ্ধি পাবে। চাঁদের কারণে পৃথিবীর উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার পরিমাণ ও সময় বাড়বে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বিশ্বজুড়ে বরফ এবং হিমবাহ গলে যাচ্ছে। এর কারণে সমুদ্রের স্তর দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
‘সমুদ্রের নিকটবর্তী নিচু এলাকাগুলির ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। ইতিমধ্যেই বহু স্থানে জলস্তর বৃদ্ধির ফলে সংকট দৃশ্যমান। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে,’ জানিয়েছেন নাসার বিল নেলসন। চাঁদের মহাকর্ষীয় টান, সমুদ্রের জলস্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে সময়ের সঙ্গে এভাবেই বন্যা বাড়বে, জানান তিনি।
পৃথিবীতে চাঁদের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই গবেষণার মূল বিজ্ঞানী ফিল থম্পসন বলেন, ‘চাঁদের ওয়াবলের প্রভাবে জলস্তর বাড়বে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এর প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে।’
ফলে সময় থাকতেই এই বিষয়ে উপকূলবর্তী শহরগুলিতে সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে, এত বেশি বন্যা মোকাবিলা সত্যিই কোনও উপায় আছে কিনা, তাই নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৭
আপনার মতামত জানানঃ