মামুন আব্দুল্লাহ : আওয়ামীলীগ বাংলার মাটিতে কতটা শক্তিশালী হওয়ার পর দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে সেটা পর্যালোচনার আগে ইউরোপের বর্তমানের একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের উপরে নজর বুলিয়ে নেওয়া যাক৷ হাঙ্গেরির তথ্যগুলোর একটিও মনগড়া নয়। সংগ্রহ করা হয়েছে স্টিভেন স্পিলবার্গের এম্বলিন প্রোডাকশনের বানানো ছয় পর্বের একটি ডকুমেন্টারি থেকে। Why we hate নামের এই ছয় পর্বের ডকু সিরিজটি ডিসকভারি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়৷ তারা যেভাবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে ছবি সহ সবকিছুই সেখান থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির সাদৃশ্য কতটুকু তা মেলানোর দায়িত্ব পাঠকের।
”যে লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা এখানে রয়েছে, তারাই আমাদের সবথেকে বড় বিপদ, যারা দক্ষিণ দিক থেকে আসছে। যদি ওরা এখানে পাকাপোক্ত ভাবে থাকা শুরু করে তাহলে সেটা আমাদের পক্ষে বিরাট ধাক্কা হবে।… আফ্রিকা থেকে আমাদের দেশে ১ কোটি মানুষ আসতে চাইছে৷ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছি। নিজে গিয়ে সেই কাজ আমি পর্যবেক্ষণ করে এসেছি, কিন্তু এভাবে অনুপ্রবেশকারীদের সাময়িকভাবে আটকানো সম্ভব। একটু আলগা দিলেই ওরা আবার দলে দলে ঢুকতে শুরু করবে এই দেশে।… আমরা আবার হাঙ্গেরির ভাগ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছি নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনের উপরেই হাঙ্গেরির আগামী ৪ বছরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।”
– ভিক্টর ওরবান
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী
২০১৮ এর নির্বাচনী প্রচারণার সময়ের ভাষণে
ভিক্টর ওরবানের এই বক্তৃতার জের ধরে সাংবাদিক মার্টন গার্গেলি বলেন, তিনি ২০১৮ সালের এপ্রিলে যখন পুনঃনির্বচনে নামেন তখন মনে হচ্ছিল তার পার্টি ফিদাজের সমর্থন কমছে। রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য তিনি উগ্র জাতীয়বাদী মতাদর্শ প্রচার শুরু করেন। ইউরোপে আগত রিফিউজিদের ভয়ংকর বক্তৃতা ও মারাত্মক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মানুষের মনে বিদেশীদের প্রতি অহেতুক ভীতি তৈরি করেন। তাই সেই নির্বাচনে জিততে জনগণকে একটি বার্তা দেওয়াই শুরু করেন, ‘বিদেশীদের ঢুকতে দেবে না। তারা সমস্যা সৃষ্টি করছে, তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসীরাও প্রবেশ করছে।’ কিন্তু বিদেশীরা সমস্যা সৃষ্টি করছে এই কথাটা পুরোপুরি সত্য না। এপ্রিলে মি. ওরবান বলেছিলেন আফ্রিকা থেকে ১ কোটি কৃষ্ণাঙ্গ হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করতে চাইছে। সেজন্য তারা অত্যাধুনিক কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করছে। অথচ পুরো মার্চ জুড়ে মাত্র ৫ জন অনুপ্রবেশকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সত্যটা হল হাঙ্গেরির যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে কেউই হাঙ্গেরিতে আসতে চায় না।
ইন্ডেক্স পত্রিকার সাংবাদিক ডেভিড সেজো বলেন, ‘উনারা শুধু মাত্র ভীতি তৈরির জন্য৷ ইউরোপকে বাঁচাতে তাদের ভোট দিন, হাঙ্গেরির ঐতিহ্যকে বাঁচাতে, সংস্কৃতিকে বাঁচাতে, নারীদের বাঁচাতে, হাঙ্গেরিয়ান নয় এমন যেকোনো কিছুর বিরুদ্ধে ঘৃণার একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়৷ আমি নব্বুইয়ের দশকে বড় হয়েছি। ফলে, আমাদের প্রজন্ম ছোট থেকেই স্বাধীনভাবে চলতে জানে। সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক পরিবেশে আমি বড় হইনি। কিন্তু গত আট বছরে আমি কল্পনা করতে পারি যে সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিজম অথবা স্বৈরশাসন ব্যবস্থা থাকার সময়টা ঠিজ কেমন ছিল। যখন সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা ছিল না, যখন বিরোধী মতকে টুটি চেপে ধরে রাখা হত। আমার মনে হয় গত ৮ বছরে হাঙ্গেরি অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।’
ভিক্টর ওরবানের একটি সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছিলাম যা ওদের দলীয় পত্রিকা Ripost এ ছাপানো হয়। সেই একই পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে তার দল ফিদাজকে ভোট দেওয়ার বিশাল বিজ্ঞাপন। বেশিরভাগ টিভি শো, টক শো হত ফিদাজকে প্রোমোট করে। বেশিরভাগ সংবাদপত্র ছিল ফিদাজের হাতে।’
‘রিপোস্টের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে একটা ভিডিও শেয়ার করা হয় যেখানে দেখা যায় একজন মহিলাকে চারজন মিলে শারীরিক নির্যাতন করছে। তার নিচে লেখা, ‘প্রতিদিন এই জিনিসই ইউরোপে ঘটে চলেছে।’ এর কারণ অনুপ্রবেশকারীরা। কিন্তু গুগল করলেই জানা যাবে এই ঘটনাটি আসলে ৪ বছর আগে এপ্রিলে ব্রাজিলে ঘটেছিল৷ এই সাইটটা সমানে মিথ্যা খবর প্রচার করে যাচ্ছে৷ ওদের সত্য খবরের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু মানুষকে ভয় দেখানোর। যদি ফেদাজকে ভোট না দাও তবে তোমার সাথে এমনই হবে, হাঙ্গেরির সাথেও এমন হবে৷ ওরা অনেক খবর ছাপে কোনো লেখকের নাম না দিয়েই। ফলে যা ইচ্ছা করতে পারে। আইনপ্রয়োগকারী কর্তাব্যক্তিরা এ নিয়ে কোনরকম মাথাই ঘামায় না।’
অনুপ্রবেশকারীদের এই ছবিটা ইউকেতে ব্রেক্সিট ক্যাম্পেনে ব্যবহার করা হয়েছিল। ফিদাজ এখানে বোঝাতে চাইছে যে, এত বিপুল পরিমাণ মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করছে। তাই তাদের থামানোর জন্য স্টপ সাইন সম্বলিত বিলবোর্ড রাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে দিয়েছে৷ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে ভয় দেখাতে। এর অর্থ, কৃষ্ণাঙ্গ ও আরবদের সীমান্তেই আটকাও।
ইলেকশনের মাত্র ৬ সপ্তাহ আগেই হাঙ্গেরির একটি শহরে ভোট অনুষ্ঠিত হয় যা শাসকদলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা এই শহরে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়। এটা একটা বিরাট হার যা রেড স্টেটে রিপাবলিকান অথবা গোপালগঞ্জে আওয়ামীলীগের হারের মতই। সেই অঞ্চলের জনগণ ফিদাজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভোটের ইশতেহার নিয়ে বিভ্রান্ত ছিল। অনেকে প্রকাশ্যে বলতে থাকে তারা ফিদাজকে ভোট দেবে না। বাকী অঞ্চলের জনগণের উপর তীব্রভাবে এর প্রভাব পড়ে। ভোটের আগেই প্রচুর ভোটার ফিদাজের বিপক্ষে কথা বলা শুরু করে। নির্বাচনটি একটি উত্তেজক নির্বাচন হতে যাচ্ছিল। সরকার পক্ষেরও সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। কিছু লোক আন্দাজ করতে পেরেছিল বুদাপেস্ট বরাবরের মতই বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল, আগামীতেও এই শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷ ভোটের দিন কয়েক কিলোমিটার লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে ভোটাররা ভোট দেন।
শেষ পর্যন্ত ৪৯.১৫% ভোট পেয়ে ফিদাজ নির্বাচনে জয়লাভ করে। ভিক্টর ওরবান আবারও ক্ষমতায় আসলেন। হাঙ্গেরি আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে মি. ওবরানই সবথেকে শক্তিশালী। তাই উনাকেই এখন নিশ্চিত করতে হবে কোনো মিথ্যা খবর যেন প্রচারিত না হয়, জনগনের বাকস্বাধীনতা যেন অটুট থাকে, বিরোধীমতের টুটি চিপে যেন না ধরা হয়।
★★★
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভেন বেনন বলেন, ‘ভিক্টর ওবরান সমগ্র বিশ্বের জাতীয়তাবাদীদের নজরে একজন হিরো হয়ে উঠেছেন। অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের উচিত তাকেই অনুসরণ করা।’ ঠিক এমনটাই ঘটেছে। ওবরানের নীতিকে অনুসরণ করেছে ট্রাম্প, মোদি, পুতিন, এরদোয়ান, ইমরান এবং আমাদের শেখ হাসিনাও। আমরা বরং কয়েক কাঠি উপরে। মরার উপরে খাড়ার ঘা হিসেবে পড়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের বলে গ্রেফতার ও গুম করা হয়েছে দেশের সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, কার্টুনিস্ট ও লেখকদের।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ