মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাব বা জিডিপি দিয়ে অর্থনীতি পরিমাপ করা যে যথাযথ নয়, অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই তা বলে আসছেন। তবে জিডিপিকে একেবারে উঁড়িয়ে দেন না তারা। কিছু ক্ষেত্রে জিডিপির হিসাবকে আমলে নিলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে যেভাবে দেশে দেশে জিডিপির আলোকে অর্থনীতির আকার ও গতিপথ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে তা নিয়ে আপত্তি রয়েছে অনেকেরই। প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের বিশেষজ্ঞরাও এবার যোগ দিয়েছেন সেই দলে।
বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে জিডিপির ব্যাখ্যা নিয়ে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, কিসের সাপেক্ষে প্রান্তিকের জিডিপি হিসাব করা হচ্ছে, তা নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান আগের প্রান্তিকের সাপেক্ষে বার্ষিক হিসাবে জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে। এই হিসাবের ব্যাখ্যা হলো, সেই প্রান্তিকের অর্থনৈতিক তৎপরতা সারা বছর চললে বছর শেষে যে হিসাব দাঁড়াবে, সেটা। লকডাউনের পর অর্থনীতি ওঠানামা করছে এবং তাতে এমন সব পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, যাতে একদিকে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, অন্যদিকে তা যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। এই হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ৩১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। এই হিসাব দেখে মনে হতে পারে, ওই প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশই গায়েব হয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো, দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশটির উৎপাদন আগের প্রান্তিকের চেয়ে ৯ শতাংশ কম হয়েছে। হ্রাসের ওই হার মোটেও কম নয়, কিন্তু অতটা নাটকীয় নয়।
সাধারণ গণিতে বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যায়। ২৯ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালাইসিস বলে, তৃতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি বার্ষিক হিসাবে ও আগের প্রান্তিকের সাপেক্ষে ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান দুভাবে বিভ্রান্তিকর, তৃতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি আগের প্রান্তিকের চেয়ে কেবল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। চূড়ান্ত হিসাবে তৃতীয় প্রান্তিকের উত্থান দ্বিতীয় প্রান্তিকের চেয়ে আকারে বড় হলেও এই প্রবৃদ্ধি বাস্তবিক অর্থে প্রবৃদ্ধি নয়, কারণ ভিত্তি হিসেবে যে দ্বিতীয় প্রান্তিককে ধরা হয়েছে, তা আগেই মহামারির ধাক্কায় সংকুচিত হয়েছে। এর অর্থ হলো, মার্কিন জিডিপি এখনো আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ শতাংশ ছোট।
একইভাবে আগের বছরের সাপেক্ষে বৈশ্বিক জিডিপিও সংকুচিত হবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের প্রাক্কলন, এ বছর বৈশ্বিক জিডিপি ৪ দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে চীন তৃতীয় প্রান্তিকে তাদের জিডিপি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। মনে হচ্ছে, তারা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে চোখের সামনে যা ঘটে বা দেখা যায় তা অনেক সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, জিডিপি হচ্ছে ‘ফ্লো ভ্যারিয়েবল’, অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি সময়ে কতখানি উৎপাদিত বা অর্জিত ও ব্যয়িত হলো। একটি উৎপ্রেক্ষা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাক, অর্থনীতি হোস পাইপ হলে কোভিড-১৯ হচ্ছে সেই পাইপে মোচড়ের মতো। কোভিডের কারণে পাইপে মোচড়ের সংখ্যা বাড়ছে বাইরে খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া এসব একপ্রকার বন্ধ। বাস্তবতা হচ্ছে, পাইপের এই মোচড় কোথাও বেশি, কোথাও কম।
আইএমএফের পূর্বাভাস হচ্ছে, প্রকৃত অর্থে ব্রাজিল, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির ২০২২ সালের জিডিপি বাস্তবে ২০১৯ সালের চেয়ে কম হবে। ইতালিতে তা ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলতে পারে। এসব প্রভাবের গভীরতা ও ধারাবাহিকতার সঙ্গে চলতি বছরের জিপিডির খুব জোরালো সম্পর্ক নেই। পরিবার ও ফার্মের আয় কমে গেলে ঋণখেলাপ বেড়ে যাবে। অথচ কোভিডের প্রভাব কেটে গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এসবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা। কোম্পানি বন্ধ হলে যেমন পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থানে ফেরত যেতে সময় লাগবে, তেমনি শ্রমিকদের দক্ষতা ফিরে পাওয়ার সময়ও বাড়বে। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে হ্রাস পাবে, শ্রমিকপ্রতি পুঁজি যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পাবে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি যে এমন নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেল, পরিমাণগত দিক থেকে তার এক চতুর্থাংশের জন্য দায়ী হচ্ছে বিনিয়োগ কমে যাওয়া।
এই ক্ষতি কমাতে পারে সরকারের উদার প্রণোদনা প্যাকেজ। ব্যক্তি মানুষ আজ কী ভোগ করবে এবং ভবিষ্যতে কতটা পারবে, তা অনেকটা নির্ভর করবে এই প্রণোদনা প্যাকেজের ওপর। তবে এতে সব সমস্যা মিটবে না। অনেকে হাতে টাকা পেয়েও ব্যয় না করে সঞ্চয়ে আগ্রহী হবে, যুক্তরাষ্ট্রে যেটা ইতিমধ্যে ঘটেছে। তৃতীয় প্রান্তিকে মার্কিনদের সঞ্চয় দ্বিতীয় প্রান্তিকের চেয়ে ৭ শতাংশ বাড়বে। তবে পারিবারিক আয় ভালো থাকলে মহামারির পর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত হয়।
চীন যে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এল, তার চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে গৃহায়ণ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ। ক্যাপিটাল স্পেন্ডিংয়ে (ক্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নতকরণ) ব্যয় বাড়িয়েছে বলে চীন সংকোচন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। সে জন্য প্রণোদনা দরকার। যারা এটার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না, তারা দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে পারছে না। পরিসংখ্যানে ভ্রান্তি থাকবেই। জিডিপির হিসাবে সরকারের তথ্য-সংগ্রাহকদের যতই কারসাজি থাকুক, এত উপাত্ত সংগ্রহ করা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু এতে সমাজের ভেতরের চিত্রটা পাওয়া যায় না। বিশেষ করে মহামারির সময় ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত।
অনুবাদ সূত্র: প্রথম আলো
আপনার মতামত জানানঃ