সমকামীতাকে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে গেছে তুরস্ক। ১ জুলাই থেকে তুস্কে আর ওই কনভেনশনে থাকছে না বলে এক ডিক্রি জারি করে জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। খবর ডয়েচে ভেলে
নারীদের নিরাপত্তা এবং পারিবারিক নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে ২০১১ সালে সই হয় কাউন্সিল অব ইউরোপ কনভেনশন অন প্রিভেনটিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন অ্যান্ড ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, যা ইস্তাম্বুল কনভেনশন নামে পরিচিত। এতে প্রথম স্বাক্ষর করেছিল তুরস্ক, পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও ৪৫টি দেশ।
কিন্তু গত মার্চ মাসে এরদোয়ান ঘোষণা দেন, তারা এই কনভেনশনে আর থাকবেন না। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্রের দাবি, ওই কনভেনশন সমকামীদের প্রশ্রয় দেয়ার চেষ্টা করছে। সমকামীদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাচ্ছে, যা তুরস্ক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। তুরস্কের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সমকাম বিষয়টি যায় না। সে কারণেই এটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তবে তুরস্ক ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে এভাবে বেরিয়ে যেতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আন্দোলন শুরু হয়েছে দেশটির ভেতরেও। একাধিক নারী অধিকার সংগঠন, বিরোধী রাজনৈতিক দল এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
নারী অধিকারকর্মী হুলিয়া গুলবাহার জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে বলেন, তুরস্কের আদালতে এ বিষয়ে আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু আদালত মামলার শুনানিতে রাজি হচ্ছে না। সর্বোচ্চ কাউন্সিলও এ বিষয়ে কিছু শুনতে নারাজ। এ কারণে আন্দোলন চলবে।
তার মতে, এই কনভেনশন থেকে বেরিয়ে গেলে তুরস্কের নারীরা আর সুরক্ষিত থাকবেন না।
এই কনভেনশনের ওপর ভিত্তি করে ২০১২ সালে নারী সুরক্ষা সংক্রান্ত একটি আইন হয়েছিল তুরস্কের পার্লামেন্টে। বিরোধীদের একাংশের বক্তব্য, কনভেনশন থেকে বেরিয়ে এলে ওই আইনের আর কোনো মূল্য থাকবে না। আর যেহেতু পার্লামেন্টে আইন হয়েছিল, তাই কনভেনশন থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্তও পার্লামেন্টেই নিতে হবে।
অবশ্য এরদোয়ান সরকার ইতোমধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, নারী অধিকার বা নারী সুরক্ষার বিষয়টি তারা দেখবে। কিন্তু সমকামীদের প্রতি কোনোভাবেই সহানুভূতি দেখানো হবে না। এটি কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না তুরস্ক।
তবে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে লড়তে চার বছরের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তুরস্ক। বৃহস্পতিবার এ পরিকল্পনা তুলে ধরেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, এ পরিকল্পনার মধ্যে পাঁচটি মূল লক্ষ্য— ২৮টি কৌশল ও ২২৭টি পদক্ষেপ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে— আইন সংশোধন এবং তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা।
এরদোগান বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে লড়াই সবসময় আমাদের অগ্রাধিকারে ছিল। সহিংসতা রোধে নেওয়া সব পদক্ষেপের প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে।
এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো— ঘরে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারী হত্যা কমিয়ে আনা।
তুরস্কের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত বছর তুরস্কে স্বামী, আত্মীয় অথবা ছেলেবন্ধুর হাতে ২৬৬ নারী নিহত হয়েছেন। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে নিহত হয়েছেন ৯৫ নারী।
পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঘরে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রথম চার মাসে গত বছরের তুলনায় কমেছে। গত বছর প্রথম চার মাসে ঘরে নারীর প্রতি ৭৭ হাজার সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। এ বছরের প্রথম চার মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজারে। কিন্তু বেড়েছে হত্যার সংখ্যা। এ সময়ের মধ্যে গত বছর ৭৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর এ চার মাসেই হত্যা করা হয় ৯৫ নারীকে। হত্যাকরীদের অধিকাংশই স্বামী বা ছেলেবন্ধু। এ ছাড়া অনেকে বাবা-মা, ভাইবোনদের হাতেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এরদোয়ানের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তুরস্কে বিক্ষোভ
সমকামীদের গুরুত্ব দিতে না চেয়ে ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে সরে এসেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তুরস্কে হাজারো মানুষ বিক্ষোভে নেমেছে।
তাদের দাবি, ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে সরে আসার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এরদোয়ান, তা প্রত্যাহার করতে হবে।
তবে এরদোয়ান বলেছেন, সিদ্ধান্ত বদলাবে না। তিনি পিছু হটার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেননি।
কিন্তু বিক্ষোভকারীরাও প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘ইস্তাম্বুল কনভেনশন নিয়ে আমরা লড়াই ছাড়ছি না। আমাদের কাছে সব শেষ হয়ে যায়নি।’
বৃহস্পতিবার এরদোয়ান চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেয়ার পরই বিক্ষোভ শুরু হয়।
এরদোয়ান বলেছেন, ‘কিছু মানুষ ভুল করে এই সিদ্ধান্তকে তুরস্কের পিছনের দিকে হাঁটা বলে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে আমাদের লড়াই ইস্তানবুল কনভেনশন থেকে শুরু ও শেষ হয় না।’
এরদোয়ান বলেছেন, ‘মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে ইতোমধ্যে আইন করেছে তুরস্ক। সেখানে ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গবৈষম্য করা হয়নি।’
অনেকগুলো অধিকাররক্ষা সংগঠন তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, তুরস্ক একটি বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর বার্তা দিতে চাইছে। তারা মেয়েদের অধিকারের বিষয়টি দশ বছর পেছনে নিয়ে যেতে চাইছে।
তুরস্কের নারী সংগঠনগুলোর ফেডারেশনের সভাপতি ক্যানান গুল্লু বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে তুরস্ক নিজের পায়েই গুলি করেছে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস জানিয়েছেন, ‘এটা খুবই হতাশাজনক সিদ্ধান্ত।’
এসডব্লিউ/ডিডব্লিউ/কেএইচ/২০৩৬
আপনার মতামত জানানঃ