ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন পর্যন্ত প্রায় একশ দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, আগামী মাসগুলোতে করোনার অতিসংক্রামক এই ধরন বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করবে। এদিকে ইউরোপের নাগরিক এবং আইনপ্রণেতারা যদি সুশৃঙ্খল না থাকেন তাহলে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ অনিবার্য বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
ডেল্টা ছড়িয়েছে প্রায় ১০০ দেশে
আগামী দিনে গোটা বিশ্ব জুড়েই সংক্রমণ ছড়াতে পারে করোনাভাইরাসের ডেল্টা প্রজাতি। প্রায় ১০০ দেশে এই প্রজাতির অস্তিত্ব মিলেছে। ভারতে প্রথম হদিশ পাওয়া ডেল্টা প্রজাতির সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
গত ২৯ জুন প্রকাশিত করোনার সাপ্তাহিক হালনাগাদ তথ্যে ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৯৬টি দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব মিললেও প্রকৃত সংখ্যা ১শ’র ওপরে। কারণ ভাইরাসের ধরন চিহ্নিতকরণের জন্য যে পরিকাঠামোর প্রয়োজন, তা অনেক দেশেই নেই। ফলে আসল সংখ্যা সামনে আসছে না।
করোনার ভারতীয় এই ধরনটি যেসব দেশে শনাক্ত হয়েছে সেসব দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে জানিয়ে সংস্থাটি আরও বলেছে, এতে করে এসব দেশে করোনায় আক্রান্ত-মৃত্যুর সঙ্গে বেড়েছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা।
ডেল্টা ধরনের অতিমাত্রায় সংক্রমিত করার সক্ষমতার বিষয়টির কথা জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, ধারণা করা হচ্ছে এই ধরন তার বৈশিষ্টের কারণে অন্য ধরনগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে এবং আগামী মাসগুলোয় আধিপত্য বিস্তার করবে বিশ্বে।
ডব্লিউএইচও বলছে, ব্যক্তি ও কমিউনিটি স্তরের জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক ব্যবস্থা, সংক্রমণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে সরঞ্জামগুলি আজ বিদ্যমান তা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার অন্য ধরনগুলোর (ভিওসি) বিরুদ্ধেও কার্যকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রস আধানম গেব্রিয়াসুস সম্প্রতি বলেছেন, ডেল্টা এখন পর্যন্ত করোনার ধরনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক ধরন। যেসব জায়গায় টিকা দেওয়ার হার কম, সেখানে করোনার নতুন এই ধরনটি দ্রুত ছড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি জানি বর্তমানে ডেল্টা ধরন নিয়ে বিশ্ব অনেক উদ্বিগ্ন। আমরাও এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অনেক দেশেই জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক বিধি-নিষেধ শিথিল করার কারণে বিশ্বে সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলফা ভ্যারিয়েন্ট ১৭২টি দেশ ও অঞ্চলে, বিটা ১২০টি দেশে, গামা ৭২টি দেশে এবং ডেল্টা ৯৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
গত ২১ থেকে ২৭ জুনের মধ্যে ব্রাজিলে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৫ লাখ ২১ হাজার ২৯৮, ভারতে ৩ লাখ ৫১ হাজার ২১৮, কলম্বিয়ায় ২ লাখ ৪ হাজার ১৩২, রাশিয়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৬৫ এবং আর্জেন্টিনায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৮২৪।
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মুখে ইউরোপ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ইউরোপের প্রধান হ্যান ক্লুগে বলেছেন, ১০ সপ্তাহ ধরে ইউরোপজুড়ে নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের যে নিম্নমুখী গতি ছিল, তার অবসান ঘটছে।
তিনি বলেন, ইউরোপের নাগরিক এবং আইনপ্রণেতারা যদি সুশৃঙ্খল না থাকেন তাহলে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ অনিবার্য। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই সতর্কবাতা দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, অবাধ চলাফেরা, ভ্রমণ, জনসমাগম এবং সামাজিক বিধি-নিষেধ শিথিলের কারণে গত সপ্তাহে ইউরোপজুড়ে করোনার নতুন সংক্রমণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবাধ চলাফেরা, ভ্রমণ, জনসমাগম এবং সামাজিক বিধি-নিষেধ শিথিলের কারণে গত সপ্তাহে ইউরোপজুড়ে করোনার নতুন সংক্রমণ প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
হ্যান ক্লুগে বলেছেন, দ্রুত বদলে যাওয়ার পরিস্থিতির কারণে করোনার সংক্রমণের এই নতুন উত্থান দেখা যাচ্ছে। করোনার নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এই অঞ্চলের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চমৎকার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও লাখ লাখ মানুষ এখনও টিকা পাননি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ না হলে ইউরোপীয় অঞ্চলে করোনার নতুন আরেকটি ঢেউ আসবে।
কোভিশিল্ডকে ‘গ্রিন পাসে’র ছাড়পত্র দিল ইউরোপের ৮ দেশ
জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, গ্রিস-সহ ইউরোপের মোট ৮টি দেশ কোভিশিল্ডকে অনুমোদন দিচ্ছে। এবার থেকে কোভিশিল্ড টিকা নেওয়ার সার্টিফিকেট সঙ্গে থাকলে এই সাত দেশে প্রবেশে কোনও বাধা নেই।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি করোনা টিকা কোভিশিল্ডকে গ্রিন পাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সমর্থন জানিয়েছে— জার্মানি, অস্ট্রিয়া, গ্রিস, স্পেন, সুইজারল্যান্ড আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, স্লোভেনিয়া।
জার্মান দূতাবাসের তরফে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুমোদিত ভ্যাকসিনের সমতুল্য টিকাকে গ্রহণের পক্ষে জার্মানি। সুরক্ষার জন্যই এত কড়াকড়ি।
এই বিবৃতিতেই স্পষ্ট, কোভিশিল্ডকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের সমতুল্য বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এই খবরে অনেকটাই স্বস্তিতে কোভিশিল্ড গ্রাহকরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিটাল ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটে কোভিশিল্ডের নাম ওঠায়, সেই নথি সঙ্গে নিয়েই তারা ইউরোপের ওই আট দেশে যেতে পারবেন— বেড়াতে অথবা কাজের প্রয়োজনে।
সূত্রের খবর, আরেক দেশ এস্তোনিয়া জানিয়েছে, ভারত থেকে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে আসা ব্যক্তিদের তাদের দেশে প্রবেশে কোনও বাধা নেই। এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও বাকি। কোভিশিল্ডে ছাড়পত্র মিললেও, কোভ্যাক্সিন যেহেতু এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায়, তাই তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্গত এই দেশগুলি।
যদিও সূত্রের খবর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ সদস্য দেশ মনে করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অথবা যে কোনও দেশে ছাড়পত্র পাওয়া ভ্যাকসিনকে এই তালিকায় রাখা উচিত। সেই টিকাগ্রহীতাদের প্রবেশে অনুমোদনের পক্ষেই অধিকাংশ দেশ। এখন কোভ্যাক্সিনের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন মহল।
করোনায় গড় আয়ু কমেছে ব্রাজিলে
করোনার প্রথম ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে ব্রাজিল। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশটি।
এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল নেচার মেডিসিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে ব্রাজিলে প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে। ২০২০ সালে এটা ১ বছর ৩ মাস কমেছে। ২০২১ সালে আরও কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, রাশিয়ায় সোমবার রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যুর পর মঙ্গলবার তা আরও বেড়েছে। আর ভারতে কমতে থাকা সংক্রমণ ফের বেড়েছে। খবর নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স ও এএফপির।
ব্রাজিলে গড় আয়ু হ্রাসের ঘটনা সাধারণত দেখা যায় না। তবে করোনায় দেশটিতে ৫ লাখ ১৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশটি। তাতে দেশটির গড় আয়ু ১ বছর ৩ মাস হ্রাস পেয়েছে, যা প্রত্যাশিত হ্রাসের তুলনায়ও অনেক বেশি।
গবেষক দলের প্রধান ও হার্ভার্ডের গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড পপুলেশন বিভাগের চেয়ারম্যান মার্সিয়া ক্যাস্ট্রো বলেন, দেশটিতে যুদ্ধ বা মহামারির মতো যখন উচ্চহারে মৃত্যু বাড়ছিল, তখন আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে গড় আয়ু হ্রাস পাবে। দেশটির পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। সেখানে খুব কম মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশটির ১ কোটির ৮০ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, যা অনুপাতের হিসাবে ১১ জনে ১ জন।
সরকারি জরিপ বলছে, গড়ে দৈনিক ৬৫ হাজার জন শনাক্ত হচ্ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে ১৬০০ জনের। দেশটিতে ১৯৪৫ সাল থেকে ২০২০ সালে এসে গড় আয়ু ৪৫ দশমিক ৫ বছর থেকে বেড়ে ৭৬ দশমিক ৭ বছর হয়েছে।
গবেষক ক্যাস্ট্রো ও তার দল বলেছে, ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে মৃত্যু বাড়ায় গড় আয়ু ১ বছর ৭ মাসের কিছু বেশি হ্রাস পেতে পারে।
এদিকে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে শিশু মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। এ ছাড়া সেখানে বহু শিশু মারা গেছে, যাদের পরীক্ষা করা হয়নি।
করোনার অতিসংক্রামক ধরন ডেল্টার প্রকোপে বুধবার রেকর্ড সর্বোচ্চ প্রাণহানি দেখেছে রাশিয়া। রাশিয়ায় মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত আরও ৬৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বুধবার এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৫ হাজার ৯৫১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৮১৭ জন, যা গত দিনের তুলনায় বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ