বিকট শব্দে কেঁপে উঠল ঢাকার মগবাজার৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আতঙ্ক গ্রাস করে এলাকায়৷ ভয়ে পালাতে শুরু করেন পথচলতি মানুষ৷ বিকট শব্দের পরই আগুন ধরে যায়৷ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ভয়াবহ বিস্ফোরণে ওই ভবন ছাড়াও আশপাশ এবং কয়েকশ গজ দূরের ভবন থেকেও জানালার কাচ আর ইটের টুকরা পড়তে থাকে বৃষ্টির মতো। অনেক দূরে থাকা গাড়ির জানালার কাচও চুরচুর করে ঝরে পড়ে।
মানুষের চিৎকার আর জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটিতে সেখানে ভীতিকর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বড় মগবাজার এলাকার আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ভবনে এই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন তিন শতাধিক এবং গুরুতর আহত ৬৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের বেশিরভাগই আশেপাশের ভবন, কয়েকটি বাসের যাত্রী এবং পথচারী।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ভবনের কোথাও গ্যাস জমে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আকস্মিক এ দুর্ঘটনায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, শরমা হাউস থেকে গ্যাসের বিস্ফোরণের আশপাশের সাতটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি বাসও লন্ডভন্ড হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মনে হয়, এটা গ্যাসের বিস্ফোরণে।
শরমা হাউসের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের ভূমিকা কী, তদারকির বিষয়টি পুলিশের ওপর বর্তায় কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে এখানে দায় তো আমাদের না। গ্যাসের সংযোগ বৈধভাবে নেওয়া হয়েছে কিনা, গ্যাসলাইনে সায়েন্টিফিক্যালি লিক-প্রুফ ছিল কিনা, তার এক্সপার্ট তো আমরা না। এ জন্য সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে। তারা এটা দেখভাল করবে।
নাশকতা কিনা এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার বলেন, নাশকতা নয়। নাশকতা হলে বোমা বিস্ফোরণে হতো। স্প্নিন্টার পাওয়া যেত। স্পিলন্টারের আঘাতে মানুষ ক্ষতবিক্ষত হতো। বাসে কোনো স্প্নিন্টারের কণা পাওয়া যায়নি। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বোমার কোনো ঘটনা এখানে নেই। গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণ হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটে বিস্ম্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কীভাবে এই বিস্ফোরণ, তা জানতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে এর সূত্রপাত।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা ছিল, যে ভবন থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত, তার দোতলায় একটি ইলেকট্রনিক কোম্পানির গুদাম রয়েছে। সেখানে থাকা এসি বা ফ্রিজ থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচের তলা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। প্রথম তলার ছাদ ধসে পড়েছে। আশপাশের অন্তত ৩০০ গজের মধ্যে থাকা ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবনের উল্টো পাশে রাস্তা পার হয়ে একটি বহুতল ভবন। সেখানে আড়ংয়ের বিক্রয়কেন্দ্র। ওই ভবনটির সব তলার জানালার কাচ ভেঙে গেছে। পাশের ‘বিশাল সেন্টার’ শপিংমলের কাচও ভাঙা দেখা গেছে। রাস্তায় আটকে থাকা বেশ কিছু বাস ও গাড়ির কাচ ভেঙে চুরমার অবস্থায় দেখা গেছে।
ঘটনার পরপরই কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তারা ঘটনাস্থলের অদূরে একটি ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই সময় বিকট শব্দ শুনতে পান। যে ভবনের নিচে তারা ছিলেন, বিস্ফোরণের সময় সেটির কিছু পলেস্তারা খসে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের ওপর পড়ে। এরপর ট্রান্সফরমার বিস্ম্ফোরণে আগুন ধরে যায়। সেই আগুন উড়াল সড়কের ওপরে ও নিচে যাত্রীবাহী বাসে ছড়িয়ে পড়ে। এতে হতাহতের ঘটনা আরও বেড়ে যায়।
পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান জানিয়েছেন, আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্থানীয় কমিউনিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিচতলায় পাওয়া গেছে হাইড্রোকার্বন
রাজধানীর মগবাজারে শরমা হাউসের নিচতলায় হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, হাইড্রোকার্বন হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি উপাদান। তবে শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক।
মগবাজারে শরমা হাউসে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনের পর আবুল কালাম আজাদ এ কথা বলেন। তিনি জানান, এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত কীভাবে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক। তদন্ত সাপেক্ষে আসল কারণ জানা যাবে। তারা তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছেন।
বিস্ফোরণে তিতাসের সংশ্লিষ্টতা নেই
রাজধানীর মগবাজারে শরমা হাউসে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাসের কোনো সংশ্লিষ্ট নেই বলে দাবি করেছে কোম্পানিটি।
আজ সোমবার তিতাসের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর গণমাধ্যমের কাছে এই দাবি করেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ।
মো. নুরুল্লাহ বলেন, শরমা হাউস ও তার দুই পাশের ভবনে তিতাসের কোনো গ্যাস–সংযোগ নেই। ঘটনাস্থলে এলপিজির সিলিন্ডার দেখতে পেয়েছেন তিতাসের তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
আজ সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় তিতাস গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (ভিজিল্যান্স) সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব তিতাসের জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক সাখাওয়াত হোসেন। আর সদস্য তিতাসের বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক সত্যজিত ঘোষ।
তদন্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তবে তিনি বলেন, তারা তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ