মানস চৌধুরী
আমাদের পরিচিতদের অনেকেই এই তর্কে একমত হতে পারেন না যে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের লিখিত পরীক্ষার পাঠ্যসূচিটা ঠিক কোন পর্যায়ের। এঁদের একাংশ একে মাধ্যমিক পর্যায়ের বলে সাব্যস্ত করে থাকেন। অন্য পক্ষ সেটাকে অতিরঞ্জন মনে করেন। তাঁদের মতে অন্তত উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের বলে গণ্য না-করা হলে বিসিএস-এর পাঠ্যসূচিকে খাটো করা হয়। এবং তাঁরা যতই বিরক্তি বা ক্রোধ থাকুক না কেন, তার কারণে এই ধরনের খাটোকরণমূলক বিচারবোধ গজাতে দেবেন না। ক্রিকেটের ডিসপুটেড সিদ্ধান্ত যেমন ব্যাটসম্যানের পক্ষে যায়, আমরা মাস্টারি করতে গিয়ে যেমন আধা নম্বরকে সামনের দিকে এগিয়ে গোটা নম্বর বানিয়ে দিই, ঠিক তেমনি আমার মনে হয় মাধ্যমিক আর উচ্চ-মাধ্যমিকের মধ্যে সংশয় থাকলে উচ্চ-মাধ্যমিক ধরে নেয়াই উচিত হবে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস কর্মচারিদের সঙ্গে অন্যান্য পেশাজীবীদের সংঘাতমূলক সম্পর্কটার মধ্যে নানানভাবেই আমলাতন্ত্র ও আমলারা আলোচনায় এসেছেন। কখনো তাঁরা শিক্ষকদের পদমর্যাদা বেতন নিয়ে আলটপকা মন্তব্যের কারণে যদি এসে থাকেন, তো অন্যসময়ে সকল কিছুতে নাক গলানোর জন্য এসে থাকেন। কিছু কিছু সময়ে তাঁরা অভূতপূর্ব কল্পনাতীত সব বক্তৃতা দিয়েও এসে থাকেন। আবার সম্প্রতি যেমন সাংবাদিক নির্যাতন করে সামনে এসেছেন। ইত্যাদি। ফলে আমলাতন্ত্রের কর্মচারিদের একাংশের কীর্তি এত সুবিস্তৃত ও বর্ণিল যে আপনি দুই প্যারা লিখে সারতে পারবেন না। কিন্তু এই সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য আমলাতন্ত্রের কর্মচারিদের আমি দায় দেবার পক্ষে নই। বরং, এর বীজ লুক্কায়িত আছে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারব্যবস্থা এর স্বীয় স্বীয় উদ্দেশ্য (বা বদমতলব) চালানোর জন্য যেভাবে আমলাতন্ত্রকে ‘ব্যবহার’ করে চলেছেন তার মধ্যে। এমনকি কয়েক দশক আগে এরশাদ নামক যে মিলিটারি মানুষটি দেশটাকে ডাণ্ডা-মেরে, ও কবিতা-লিখে, চালাতেন তাঁর মাখনের মতো স্মুদলি সিভিলিয়ান, ও পকেটে-গোলাপফুল পার্লামেন্টারিয়ান, বিশেষ উপদেষ্টাও বটে, হয়ে পড়বার সময়কাল থেকেও ঘটে থাকতে পারে। রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারী দল আমলাতন্ত্রকে যত ‘ব্যবহার’ করে চলেন, ততই ‘দুর্ব্যবহার’ শিখতে থাকেন আমলাতন্ত্র।
তাছাড়া শিক্ষকদের কথাই বা আর কী কব! অধ্যাপকদের পদমর্যাদা পৌণে-সচিব না উন-ব্রিগেডিয়ার এসব আলাপ তাঁরা নিজেরাই করতে থাকেন। দুইটা-তিনটা করে চা, চারটা করে সিঙ্গারা শেষ হয়ে যায় লাউঞ্জের। তারপরও তাঁরা আরেকটু উঁচু মর্যাদার জন্য চারজনে মিলে মরিয়া চেষ্টা করতে থাকেন। রেকর্ড করিনি, কিন্তু নিজের কানে-শোনা। ফলে আমলাদের মধ্যে একাংশ যে বকমবকম আর ধমকাধমকির অভ্যাস গড়ে তুলবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু দেখি না। সে যাহোক, সাংঘর্ষিক হুমহামমূলক একটা আমলাতন্ত্র তৈরি হলেও, এবং তাঁদের সুবিস্তৃত কর্মকাণ্ড ঠিক বেড়ে না পাওয়া গেলেও দু্ইটা বিষয় জনমানসে মোটামুটি তর্কাতীত প্রতিষ্ঠিত। একটা হলো, আমলাতন্ত্রের নেতৃস্থানীয় অংশ বেশুমার দুর্নীতিপরায়ণ। দ্বিতীয়টা হলো, যতই এর-তার সঙ্গে হাত-পা চালিয়ে মোড়লীপনা আর ধামকাধামকি করতে থাকুন না কেন, আমলাতন্ত্রের কর্তারা সেনাবাহিনির সঙ্গে ইয়ে করতে যান না। দ্বিতীয় বিষয়টা নিয়ে বেশিক্ষণ পর্যালোচনা করতে থাকা হৃৎপিণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর হবে না। আজকাল ডাক্তাররা টি-২০ ম্যাচের সময়েও হার্টের রুগিদের হামদ-নাদ কিংবা বিটিভির দেশাত্মবোধক গিটারের মর্মান্তিক সুরগুলো শুনতে সুপারিশ করেন। যাহোক প্রথমটা নিয়েও বেশিক্ষণ আলাপ করলে লোকে প্রমাণ চাইবেন। আর তা দিতে পারব না বিধায় ঝামেলা বেধে যাবে। তবে আমি নিজে যেহেতু মাস্টারি করে খাই, আমার জন্য এমন সূত্র বলে দেয়াই ইমানদারিত্ব হবে যে সূত্রে আমার পেশাও বাধা আছে। মোটামুটি সামর্থ্য আর কাজচালানো পরিচয় আছে এমন কোনো লোক যদি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে/বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ে/সচিবালয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রদত্ত “গবেষণা অনুদান”গুলোর একটা তালিকা, উদ্দেশ্য, আর টাকার পরিমাণ জানতে পারেন, তো প্রাথমিকভাবে কথিত ‘দুর্নীতি’র মেলাখানি জানা হয়ে গেল আপনার। তবে আরো ভাল হয়, টাকার পয়লা এমবার্সমেন্টের সময়কালে “গবেষক”-এর (জ্বি এখানে অধ্যাপকের কথাই হচ্ছে) ব্যাংক ট্রান্স্যাকশনগুলো যদি একটু হিসাব নিতে পারেন। তবে এসব করতে গিয়ে যদি আপনার টয়লেটে আটকা পড়ে রাজকর্মচারিদের পিটানি খেতে হয়, অবশ্যই তার দায়দায়িত্ব আমি নেব না।
তবে আজকের মূল প্রতিপাদ্য আমার ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি যাইওনি। কারিকুলাম বা পাঠ্যসূচি নিয়ে মৌলিক একদম অরজিনাল ভাবনা আমার আসে একদিন নৈমিত্তিক বাসসফরে। তবে পৃথিবীতে ক্যাজুয়েল কর্মকাণ্ডে বড় বড় আবিষ্কারের অজস্র নজির আছে, যদিও লোকে কেবল নিউটনের আপেলটার খবরই রাখেন। আমি ঢাকা থেকে ভোরের বাসেও কখনো কখনো জাহাঙ্গীরনগর যেতাম। বাতিক ছিল ক্লাস নেবার, সকালে বাসে চড়ার, ক্যাম্পাসের নাস্তা খাবার। এইসব আরকি। তো দেখি কী! লোক প্রশাসন কেন্দ্রের মাঠে খাঁকি হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বন্দুক কাঁধে কারা যেন দৌড়াদৌড়ি করেন পুরুষকুল। এমন নয় যে দৌড়াদৌড়িওয়ালাদের প্রতি আমার কোনো হিংসা আছে। আমি নিজে অলস। কিন্তু অন্যেরা সকালে উঠে দৌড়াদৌড়ি করলে আমি প্রায় ভক্তিমূলক শ্রদ্ধা করে থাকি, অবশ্যই যতক্ষণ তাঁরা আমাকে টানাটানি না করবেন। আবার ওই খাঁকি প্যান্ট বা স্যান্ডো গেঞ্জি পরার কারণে আলাদা করে কোনো হতভম্বতার কারণ নেই। ওগুলো না থাকলেই বরং তাকানো কঠিন হতো। কিন্তু আমার বাসের ডান হাতে তখন মিলিটারি ফার্ম। অথচ এঁরা দৌড়াচ্ছেন বাম দিকের জানালায়। ফলে এক বা পৌণে এক সেকেন্ডের জন্য আমার ফরাসী ধ্রুপদী সিনেমার মতো স্থান-কাল-পাত্র-বিভ্রম হয়ে গেল। ওই দপ্তরের মাঠে যে সিভিল-প্রতিপালকেরাই দৌড়াবেন তা আমার বিলক্ষণ জানা ছিল। কিন্তু তাঁদের কস্টুম আর প্রপস আমাকে ভাবায়। ফলে আমি ক্যাম্পাস ফিরে যাবার পর থেকেই তাঁদের এই নয়া স্বাস্থ্য-পেডাগজি সম্বন্ধে খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করি। সে অনেক দিন আগের কথা, হয়তো ২০০২ হবে।
আমার জীবনে কোনো খোঁজখবরই সহজ না। আমার পরিচিতদের দেখি মুহূর্তের মধ্যে তলোয়ারের মতো মাজা থেকে মোবাইল বের করে সচিবালয়ের সচিব তো ডাক্তারদের স্বাচিপ তো বায়তুল মোকাররমের খতিব যে কাউকে ফোন লাগিয়ে বলে ‘দোস্ত আমার একটা হেল্প লাগবে’। আমার এসব ক্ষেত্রে ১৭ দিন লাগে আগে বুঝতে কার কাছে বললে তিনি একটুখানি রাস্তা বলে দিতে পারবেন। তার মধ্যে ১৭ দিন পর যাঁদের বলি, তাঁরাও আমার স্বভাবচরিত্র জানেন বলে বিশেষ উৎসাহ দেখান না ঘটকালি করতে। আমার মনে পড়ে, কয়েকদিন চেষ্টাচরিত্র করেও আমি মুদ্রিত বা ডিজিটাল ফাইলে লোক প্রশাসনের কারিকুলাম বের করতে পারিনি। তবে ততদিনে খানিকটা ভাবাভাবি, টুকরাটুকরি শোনাশুনি আর আমার প্রখর বুদ্ধিতে আন্দাজ করে ফেলি কী বস্তু হয়ে চলেছে ওটা।
এই যে উচ্চ-মাধ্যমিকের পরেই মধ্যবিত্ত বাংলার পুরুষকুল, এমনকি এখন নারীকুলও, মিলিটারি-মানব হতে থাকছেন এত বছর ধরে, তার উপকারগুলো ভেবেছেন? বাংলার মা-বাবারা যে কেবল সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পেরেছেন তাই-ই নয়, বরং গলার স্বর উঁচু করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথাও বলতে পারছেন। লোকে বলে এটা নাকি ৮০’র দশকে তীব্র ছিল। কিন্তু এখন কমে গেছে গুরুতর তাও মনে হয় না। বরং বাণিজ্যে মন আসার পর হয়তো আরো সূক্ষ্ম ও ‘বিনয়ী’ হয়েছে এই মিলিটারি সত্তা। ২০০৮-এই আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে ‘খেঁকানি-কম্যুনিকেশন পলিসি’ একেবারেই নেই সামরিক আমলাতন্ত্রের। তাঁরা বদলে ফেলে এটাকে পরিপূর্ণ ‘মৃদুহাস্য কম্যুনিকেশন পলিসি’তে রূপান্তর ঘটিয়েছেন। বরং সত্যি কথা বললে, কেউ প্লিজ হিংসা করবেন না, সামরিক আমলাতন্ত্রের এখনকার যোগাযোগ পদ্ধতি সিভিল আমলাতন্ত্রের থেকে অনেক দক্ষ, সূক্ষ্ম, কম হুমহামকারি, অধিকতর দরকারি। তাঁরা কীভাবে পারলেন এটা? পারলেন অনেকগুলো কারণে ও উপায়ে। একটা হলো, তাঁরা চেয়েছেন আগের যুগের ধমক-পলিসির রদবদল, আন্তরিকভাবে। আরেকটা হলো, এই কাজটাতে তাঁরা নিবিড়ভাবে তালিম দেন একজন শিশুর উচ্চ-মাধ্যমিকের পর থেকেই। আচ্ছা উচ্চ-মাধ্যমিক পাশেরা সকলে ঠিক শিশু নন। তবে জাতিসংঘের হিসাব মানলে সেমিশিশুই। আর গত কয়েক বছরে সারা দুনিয়ার সামরিক বাহিনি জাতিসংঘকে কতটা মান্য করে তা আপনারা জানেন। না জানলেও জেনে নিন। কেবল জাতিসংঘকে মান্য করতে গিয়েই নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নাইজেরিয়া বা সিয়েরোলিয়েনের দেশপ্রেমী কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে মারবার কাজ করতে হচ্ছে তাঁদের, আই মিন দেশদ্রোহী কর্মীদের। তাহলে আদব ও দক্ষতা বৃদ্ধির কাজটি উচ্চ-মাধ্যমিকের পর থেকেই নিবিড়ভাবে করা যে ভাল তার প্রমাণ হাতে-নাতেই পাওয়া সম্ভব।
যেহেতু লিখিত পরীক্ষার সিলাবাসটি উচ্চ-মাধ্যমিকীয়, যেহেতু অন্য আরো সফল আরো প্রতাপশালী বিভাগে হাতেনাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে, যেহেতু আমলাতন্ত্রের নেতৃবর্গ অন্যদের ধমকাধামকি করার কাজটা নিবিড়ভাবে করে যেতে চান, এবং যেহেতু দুর্নীতি করাকরি নিয়ে সামান্যই ঝামেলা বরং মৃদু ঝামেলা হলো তা প্রকাশ পাওয়া নিয়ে, আর যেহেতু নিবিড় দীর্ঘকালের তালিমে মৃদুহাস্য-চামেচিকনে পলিসি রপ্ত হবার সম্ভাবনা প্রখর-তাই আসলে উচ্চ-মাধ্যমিকের পরেই সিভিল কর্মচারি/কর্মকর্তা (এ নিয়ে আইনি ও সম্ভ্রমগত দুইটা রায় আছে) নিয়োগের চিন্তা করা এখন যুগোপযোগী হবে বলে আমি দাবি করছি।
আমার নিজের তাতে কী লাভ? আপনাদের জানতে চাইবার অধিকার আছে। আমি যেখানে চাকরি করি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো উপকার না হলেও লাইব্রেরিগুলো বিসিএস ধাওয়াকারী ইয়ুথদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সেটা একটা জানে-শান্তি ধরনের লাভ। তবে বিসিএস নিয়োগ উচ্চ-মাধ্যমিকের পরেই সাব্যস্ত হবার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর দরকার কী আছে এই প্রশ্ন যদি মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী আমাকে করে বসেন, আমার আসলেই কোনো জবাব নেই। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করব। মাথা চুলকে, পিছনের যে অংশে চুল আছে সেখানে, তাঁকে অনুরোধ করব যেন তিনি গরিব এই সেমিবৃদ্ধ শিক্ষকের জন্য একটা গোল্ডেন হস্তমর্দনের ব্যবস্থা করেন।
মর্দিত হস্তে টাকা নিয়ে বাসায় বসে অবসরকালীন এটাসেটা করব। হতে পারে তদ্দিনে গণসংহতি আন্দোলন আমাকে ‘প্রকৃত মিত্র’ হিসাবে সাব্যস্ত করতে পারছেন। কে না জানে অপেক্ষায় মেওয়া ফলে! এবং হয়তো তাঁরা স্পষ্ট-বোধগম্যভাবে আমাকে রচনা লিখনের নিমন্ত্রণ জানাতে পারছেন। হয়তো তাঁদের নিমন্ত্রণে আমার ‘এদ্দিনে মিত্র হইলাম’ আনন্দে আরেকটা রচনা লেখাও হবে, আজ যেমন হলো।
মানস চৌধুরী, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
আপনার মতামত জানানঃ