করোনা মহামারীর শুরুর দিকে বিশ্বজুড়ে খাবারের দাম তুলনামূলক কম ছিল। সময় যত গড়িয়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম ততই লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতায় টানা ১২ মাস ধরে খাবার কেনায় বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। বিশ্বে দ্রুতগতিতে খাবারের দাম বাড়ার রেকর্ড তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সর্বকালের শীর্ষে উঠে আসার অল্প কয়েক ধাপ পেছনে রয়েছে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যসূচক। ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়লেই এটি মাইলফলক স্পর্শ করবে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চাহিদা বৃদ্ধি এবং কম উৎপাদন অব্যাহত থাকলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। বিবিসি, রয়টার্স
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ফ্রুড প্রাইস ইনডেপের মাধ্যমে বিশ্বে শস্য, তেলবীজ, নিত্যপণ্য, মাংস, চিনিসহ নানা খাবারের দাম পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এই সূচকের পাঁচটি উপাদানের দামই বেড়েছে। কয়েকটি দেশে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে দাম বেড়েছে। এছাড়া চলাচল নিয়ন্ত্রণ করায় সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় স্থানীয়ভাবে তৈরি হওয়া সংকটও দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
বিবিসি জানায়, বিশ্বজুড়ে খাবারের দামের একটি বৃহৎ সূচক ব্যবহার করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এ পরিসংখ্যান বের করেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ওই ইনডেক্সে দেখা গেছে, পুরো বিশ্বেই গত ১২ মাস ধরে টানা খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
তার মধ্যে মে মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সূচক সর্বোচ্চ ১২৭ দশমিক ১ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাস আগের (এপ্রিল) তুলনায় যা ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি এবং গত বছর মে মাসের তুলনায় ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এফএও-র ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০১০ সালের অক্টোবরের পর এটাই এক মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সূচক।
মূল্যসূচকের হিসাবে মে মাসে সর্বোচ্চ বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি ও খাদ্যশস্যের দাম। এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহকৃত সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তির দিকে ছিল। এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর রেকর্ড সর্বোচ্চ। এফএও জানায়, সর্বকালের শীর্ষে উঠে আসার অল্প কয়েক ধাপ পেছনে রয়েছে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক মূল্যসূচক। ৭ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়লেই এটি মাইলফলক স্পর্শ করবে।
মে মাসে এফএওর খাদ্যশস্যের মূল্যসূচক এপ্রিলের তুলনায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টার দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারদরে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। কৃষিপণ্যটির দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গড়ে ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় মে মাসের শেষ দিকে ভুট্টার দাম কমতে থাকে। মাসের শেষ দিকে গমের দামও কিছুটা কমে আসে। তবে ওই মাসে কৃষিপণ্যটির দাম এপ্রিলের তুলনায় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল ছিল।
গত মাসে বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেলের দামও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এ সময় পণ্যটির মূল্যসূচক এপ্রিলের তুলনায় বেড়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। পাম অয়েল, সয়াবিন ও সরিষার তেলের চড়া বাজার ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক দরবৃদ্ধিতে প্রধান জ্বালানি জুগিয়েছে। এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাম অয়েল উৎপাদনে মন্থরগতির কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে। এদিকে বৈশ্বিক চাহিদা বিশেষ করে বায়োডিজেল খাতে চাহিদা তুঙ্গে ওঠায় বেড়েছে সয়াবিন তেলের দামও।
মে মাসে চিনির মূল্যসূচক এপ্রিলের তুলনায় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বের শীর্ষ চিনি রফতানিকারক দেশ ব্রাজিল। এ বছর দেশটিতে আখ সংগ্রহ ও মাড়াই দেরিতে শুরু হয়। এছাড়া আখ উৎপাদনও তুলনামূলক কম হয়েছে। ফলে ভারত বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি রুখতে বিশ্ববাজারে বড় পরিসরে চিনি সরবরাহ করলেও প্রক্রিয়াজাত পণ্যটির দাম বেড়ে যায়।
একই মাসে মাংসের মূল্যসূচক এপ্রিলের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। চীন আমদানি বাড়িয়ে দেয়ায় সরবরাহ সংকটের আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের মাংসের দাম বেড়ে যায়। এদিকে বিশ্বের শীর্ষ মাংস উৎপাদনকারী দেশগুলোর স্থানীয় চাহিদা ও ব্যবহার বৃদ্ধিও মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্ববাজারে গত মাসে দুগ্ধপণ্যের দাম আগের মাসের তুলনায় ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। গত এক বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার ২৮ শতাংশ। ননিযুক্ত ও ননিবিহীন গুঁড়ো দুধের আমদানি চাহিদা জোরদার হওয়ায় পণ্যটির দাম বেড়েছে। তবে নিউজিল্যান্ড আন্তর্জাতিক বাজারে মাখনের সরবরাহ বাড়ানোয় গত এক বছরে প্রথমবারের মতো দুগ্ধপণ্যটির দাম কমে যায়।
এদিকে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক উৎপাদন নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে এফএও। চলতি বছর উৎপাদন গত বছরের তুলনায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ২৮২ কোটি ৮০ লাখ টনে পৌঁছবে বলে জানানো হয়।
খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে যোগান কমে যাওয়া কথা বলা হয়েছে। মহামারীর মধ্যে পরিবহন ও শ্রমিক সংকটে খাদ্য পণ্যের উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটেছে। আর উৎপাদন কমে যাওয়ায় যোগানেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এছাড়া কয়েকটি দেশে খাদ্যপণ্যের চাহিদাও বেড়ে গেছে।
যার ফলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মুদ্রাস্ফীতি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যপণ্যের পেছনে মানুষের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মহামারী পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারেও তার উচ্চ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্য, তেলবীজ, দুগ্ধজাত খাবার, মাংস এবং চিনির মত খাদ্যপণ্যের দাম অনুসরণ করে এফএও এই ইনডেক্স তৈরি করেছে।
যে পাঁচটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে এই ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে তার সবগুলোরই দাম বেড়েছে। যার ফলে ভেষজ তেল, শস্য এবং চিনির দাম বেড়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই নানা মেয়াদে লকডাউন দিয়েছে। লকডাউনে চলাচলের উপর নানা বিধিনিষেধ থাকায় খাদ্যপণ্যের বাজারজাতকরণ এবং সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। যোগানের অভাবে অনেক জায়গায় খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে এবং দাম বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এখনো নানা দেশে লকডাউন চলছে। তারমধ্যে খাবারের উচ্চ চাহিদা এবং উৎপাদন কমে যাওয়া অব্যাহত থাকলে মু্দ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। মুদি দোকানের অতিরিক্ত বিলের প্রভাব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলেও আশঙ্কা তাদের।
তবে আশার কথা হলো, কিছু কিছু শিল্প মহামারীর সংকট দারুণ ভাবে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এছাড়া এফএও থেকেও এবছর বিশ্বজুড়ে রেকর্ড পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদন হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। যা খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ