পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং এর কাছাকাছি এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এ পরিণত হয়েছে।
এজন্য সমুদ্র বন্দরগুলোকে দুই নম্বর দূরবর্তী হুশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আজ সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে একই এলাকায় (১৬.৬০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯.৫০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি আজ (সোমবার) সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫০ কি.মি. দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কি.মি. এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ৮৮ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর বিক্ষুব্ধ অবস্থায় রয়েছে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
ঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে দুই নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে তাদের গভীর সাগরে না যেতে বলা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে; পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, সোমবার ভোর ছয়টায় নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর- উত্তর পশ্চিমে অগ্রসর হতে পারে। ২৬ মে বুধবার নাগাদ উড়িষ্যা-পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের খুলনা উপকূলে পৌঁছতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি।
২৬ মে আঘাত হানতে পারে
আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী ২৬ মে বুধবার ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বাংলাদেশের খুলনা ও সাতক্ষীরা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের কাছে সাগর উত্তাল রয়েছে।
এর আগে রোববার রাতে আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে পূর্বাভাস আছে, তাতে নিম্নচাপটি যদি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়, তাহলে সেটা বুধবার (২৬ মে) দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে আঘাত হানা শুরু করতে পারে। এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ সম্ভাবনা হলো ভারতের ঊড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করতে পারে। বাংলাদেশের সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, উত্তর আন্দামান সাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে যে লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস দেয়া হচ্ছে, সেটি যদি ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এ রূপান্তর হয়, তবে তা এক পর্যায়ে শক্তিশালী ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পুরো উপকূলকে সতর্ক থাকতে হবে।
এ ছাড়া আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ মোকাবিলার নির্দেশনা দিয়ে রোববার মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে অনলাইনে এক জরুরি সভা করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
অনলাইনে যুক্ত হয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক বলেন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা আমাদের জন্য নতুন নয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাঁধ মনিটরিংসহ জরুরি কাজের জন্য পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ প্রস্তুত রয়েছে। সেইসঙ্গে প্রকৌশলীদের কাছে আক্রান্তদের জন্য মাস্ক, স্যালাইনের ব্যবস্থা রাখা হবে।
মাঠপর্যায়ে সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়ে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, জরুরি ভিত্তিতে লোকবল নিশ্চিত করাসহ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ স্টেশন ত্যাগ করতে পারবে না। কোথাও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইয়াস টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা তাণ্ডব চালাতে পারে
সাগরে গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে রবিবার রাত থেকে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরা, ভোলা, বাগেরহাটসহ উপকূল ও সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সঙ্গে হালকা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।
রবিবার রাত ১০টায় ঘূর্ণিঝড়ের সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস জানান, বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসা সাইক্লোন ইয়াস টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা তাণ্ডব চালাতে পারে। এ সময় বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি মূলত পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষা উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশের খুলনা উপকূলেও আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে ঝড়টির। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইয়াসের তীব্রতা আম্ফানের চেয়েও বেশি হতে পারে
এক বছর আগে সুপার সাইক্লোন ‘আম্ফান’ লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল সুন্দরবন সন্নিহিত উপকূলভাগ। সেই আম্ফানের চাইতে অতিকায় আয়তন-আকার-ব্যাসার্ধের ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ উত্তরমুখী হয়ে ধেয়ে আসছে।
আবহাওয়া বিশ্লেষকরা ধারনা করছেন, এই সাইক্লোনের তীব্রতা আম্ফানের চাইতে বেশি হবে।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, সাগর উত্তাল হয়ে ফুঁসছে। আগামীকাল ‘ইয়াস’ সিভিয়ার সাইক্লোনের চেহারা নিতে পারে। গভীর নিম্ন্নচাপটির ব্যাসার্ধ ৬০০ কিলোমিটার। আম্ফানের ব্যাসার্ধ ছিল ৪৫০ কিলোমিটার। অর্থাৎ ইয়াস প্রায় ১২০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অতিক্রম করবে। সাগরে ১৩০ থেকে ১৪৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় বেগ থাকলেও ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিবেগ নিয়ে ইয়াস আছড়ে পড়বে উপকূলে। সুপার সাইক্লোনটির কেন্দ্র বুধবার ভোররাতে বাংলাদেশ উপকূলের আগে প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত হানতে পারে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর উড়িষ্যায়। বুধবার পূর্ণিমার ভরা কোটালে পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণকালে ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করবে ইয়াস।
২০০৯-এ ঘূর্ণিঝড় আইলা এসেছিল ভরা কোটালে। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল সুন্দরবন সন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকা। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি, জীবনহানি ঘটেছিল। আর ২০২০-র আম্ফান এসেছিল ভাটার সময়। ফলে ক্ষয়ক্ষতি তুলনায় কম হয়েছিল। এবার ইয়াস আসছে ভরা কোটালেই ভয়ংকর বিগ্রহে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, খুলনা থেকে চট্টগ্রাম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে ঘূর্ণিঝড় যশ।
উপকূলে প্রস্তুতি শুরু, তিনগুণ বেশি আশ্রয়কেন্দ্র
উপকূলে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের চেয়ে তিনগুণ বেশি আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহার করা হবে। প্রায় ১৪ হাজার ৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৪ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। এবারও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে তিনগুণ বেশি আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবহার করা হবে। সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক ও সেনিটাইজার বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি এরমধ্যে যদি কোনও কোভিড আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় তাহলে তাকে আইসোলেশনে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে করে কোনোভাবেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কেউ সংক্রমিত না হয়।
আশ্রয়ন্দ্রেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। এলাকায় এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে, ঝড়ে রাস্তায় গাছ পড়লে তা সরাতে কাজ করবে ফায়ার সার্ভিস। স্কাউটের প্রায় ছয় লাখ সদস্য কাজ করতে পারবে উপকূলে। এছাড়া নেভি, পুলিশ, বিজিবি, আনসার-ভিডিপি, কোস্টগার্ডসহ সবগুলো সংস্থা এই ঝড় মোকাবিলায় একযোগে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে নগদ টাকার সহায়তা জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে। প্রচুর শুকনা খাবার মজুদ আছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ