করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত। সেখানে প্রতিদিন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভারতীয় নতুন ধরনের করোনা পূর্বসূরী প্রচলিত ভাইরাসের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। এর প্রভাবে বাজারে প্রচলিত করোনা টিকাগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথান এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। একইসাথে করোনা সংঙ্কট মোকাবিলায় টিকাদানই একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্ট ড. ফাউসি।
ভারতীয় ধরনে টিকা অকার্যকর
সম্প্রতি ফ্রান্সের বার্তাসংস্থা এএফপিকে এক সাক্ষাৎকারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) শীর্ষ বিজ্ঞানী ও গবেষক সৌম্য স্বামীনাথান বলছেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অনেক শক্তিশালী। করোনার এই ভ্যারিয়েন্ট বাজারে প্রচলিত টিকাগুলোকে অকার্যকর প্রমাণিত করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘ভারতে বর্তমানে করোনা সংক্রমণের যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে এটা স্পষ্ট যে, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বি.১.৬১৭ প্রচলিত ভাইরাসটির তুলনায় অনেক বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বেশ বিপজ্জনক। সার্স-কোভ-২ বা প্রচলিত করোনাভাইরাসের কয়েকবার অভিযোজনের (মিউটেশন) পর এসেছে এটি।’
তিনি বলেন, ‘বি.১.৬১৭ প্রচলিত ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর তুলনায় অত্যন্ত দ্রুত ও বেশিসংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এমনকি, টিকা নেওয়ার পর শরীরে যে করোনা প্রতিরোধী শক্তি জন্মায়, তাকেও ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই ধরনটির।’
গত বছর অক্টোবরে প্রথম শনাক্ত হয় বি.১.৬১৭। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশের সরকারি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এই ধরনটিকে ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এএফপিকে সৌম্য স্বামীনাথন জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সম্প্রতি বি.১.৬১৭ ধরনটিকে করোনাভাইরাসের ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এই ভারতীয় গবেষক বলেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বি.১.৬১৭ প্রথম গত অক্টোবর মাসে ধরা পড়ে। এরপর কতদ্রুত এটি লাখ লাখ মানুষকে সংক্রমিত করেছে।
ফলে এটা স্পষ্ট যে, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বি.১.৬১৭ প্রচলিত ভাইরাসটির তুলনায় অনেকগুণ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বিপজ্জনক। প্রচলিত করোনাভাইরাসের কয়েকবার অভিযোজনের পর নতুন এই ধরণটি এসেছে। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে।
তিনি বলেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত শক্তিশালী যা খুব দ্রুত মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।
ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্ক তিনি বলেন, ভারতে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গণটিকাদান কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি ভারতে সবগুলো রাজ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই সব মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরামর্শ দেন।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে সৌম্য স্বামীনাথান ভীড় এড়িয়ে চলা, বড় ধরণের গণ জমায়েত না করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ভারতে করোনা সঙ্কটের একমাত্র সমাধান টিকাদান
ভারতে করোনা সংঙ্কট মোকাবিলায় টিকাদানই একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্ট ড. ফাউসি। গতকাল রোববার এক সাক্ষাৎকারে মহামারি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে টিকা তৈরি ও টিকাদান নিশ্চিত করতে বিশ্ব ব্যাপী উদ্যোগ গ্রহণ করতে তিনি আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রধান মেডিকেল উপদেষ্টা ফাউসি এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে টিকাকরণের উপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত ভারতের। প্রয়োজনে শুধু দেশজ উৎপাদনের উপর ভরসা না করে বিদেশ থেকেও টিকা আমদানি করুক ভারত, এমনটাই মত তার।
ভারতে করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালের শয্যা এবং অক্সিজেন ঘাটতি নিয়েও মন্তব্য করেছেন ফাউসি। তার ভাষায়, মানুষকে অক্সিজেন দিতে না পারা অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয়।
তিনি বলেন, হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে মানুষ এভাবে রাস্তায় থাকতে পারে না। তার ভাষায়, হাসপাতালে শয্যা ঘাটতি পূরণে ভারতের উচিত অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা।
ফাউসি বলেন, গত বছর চীন অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিল। ভারতেরও অবিলম্বে এই পথ অনুসরণ করা উচিত।
৮০ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্রের এই ভাইরোলজিস্টের মতে, পরিস্থিতি মোকাবিলা ভারতে এখনও হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন, পিপিই এবং অন্যান্য মেডিকেল সরঞ্জামের ঘাটতি রযেছে। তার ভাষায়, ভারতের করোনা সংক্রমণের ধারবাহিকতা কমাতে এই মুহূর্তে লকডাউন একমাত্র কার্যকরী উপায়।
ড. ফাউসি বলেন, টিকাদান করোনা রুখতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলেও এই মুহূর্তে সংক্রমণ কমাতে ভারতে লকডাউন দেওয়া প্রয়োজন। এজন্য ছয় মাস নয়, সংক্রমণ কমাতে কয়েক সপ্তাহের জন্য দেশটিতে লকডাউন দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তবে দীর্ঘমেয়াদে টিকাদানই ভারতে করোনা রুখতে সাহায্য করবে বলে দাবি করেছেন ড. ফাউসি।
ভারতে করোনার বর্তমান পরিস্থিতি
মাঝে কিছুদিন আশার আলো জাগিয়ে ফের ঊর্ধ্বমুখী ভারতের করোনার গ্রাফ। শনিবারের থেকে রবিবারের রিপোর্টে ফের বাড়ল আক্রান্তের সংখ্যা। এদিনও আক্রান্তের সংখ্যা রয়েছে ৪ লক্ষের উপরে। মৃত্যুর সংখ্যা এদিনও ৪ হাজারের উপর। তবে শনিবারের চেযে রবিবারের রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা অল্প কম।
রবিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোটা দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ৪ লক্ষ ৩ হাজার ৭৩৮ জন। মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ৯২ জনের। এই নিয়ে পরপর ২ দিন দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজারের উপরে রইল।
এদিকে ভারতে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন লাখ ৬৬ হাজার ৩১৭ রোগী শনাক্ত হয়েছে, এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে তিন হাজার ৭৪৭ জনের।
দেশে ভারতীয় ধরন
দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় একটি ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতীয় ধরনের চার জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইডিসিআর) এ তথ্য জানিয়েছে।
এ সংক্রান্ত তথ্য জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটাতে (জিএসআইডি) প্রকাশিত হয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) বিজ্ঞানী সৈয়দ মুক্তাদির আল সিয়াম বলেন, গত ২৮ ও ২৯ এপ্রিল দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) বি.১. ৬১৭.২ পাওয়া গেছে। আইইডিসিআর এটি সাবমিট করেছে। এর নমুনা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ (আইডেশস)। তবে দেশে পাওয়া ভ্যারিয়েন্টে ই৪৮৪ মিউটেশনটি নেই। এটা থাকলে খুব ক্ষতিকর হতো।
যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ভাইরাসের ভারতীয় তিনটি ধরনের মধ্যে বি.১.৬১৭.২ ধরনটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.নাসিমা সুলতানা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সম্প্রতি বেনাপোল বন্দর হয়ে ভারতফেরত কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়। তার মধ্যে দুটি নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের পরীক্ষায় একই ফল পেয়েছে জানিয়ে নাসিমা সুলতানা বলেন, “এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই মানুষকে খুবই বেশি সতর্ক থাকতে হবে।”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ৬ মে যশোর ২৫০ শয্যার হাসপাতাল থেকে ভারত ফেরত ১৬ জনের নমুনা পাঠানো হয়। নমুনা পরীক্ষা করে তাদের ৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়।
অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক মো. ইকবাল কবীর জাহিদের নেতৃত্বে গবেষকরা জেনেটিক সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করেন। তাতে দুজনের শরীরের পাওয়া করোনাভাইরাস যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
“স্যাম্পল অ্যানালাইসিস করার পর আমরা দুইজনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বি১.৬১৭.২ পেয়েছি। দুজনের মধ্যে একজন নারী, একজন পুরুষ।”
ভারতীয় নতুন ধরনটির আরও বেশি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সীমান্তে আরও কড়াকড়ি আরোপের পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, “বর্ডার পুরো বন্ধ করতে হবে। ভারত থেকে আসা পণ্যের সঙ্গেও লোকজন যাতায়াত করছে। এই মিক্সিংটাও কেয়ারফুলি হ্যান্ডল করতে হবে। বর্ডার অঞ্চলের মানুষকে দ্রুত টিকা দিতে হবে।”
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ