একদিকে করোনা মহামারি, অন্যদিকে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ। এরই মধ্যে এই রমজানে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে পানির তীব্র সংকট। রাজধানীর ঘরবন্দি বিভিন্ন এলাকার মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। সংকটের জন্য ঢাকা ওয়াসার ব্যর্থতাকেই দুষছেন বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। অথচ এমন সময়েই কাণ্ডজ্ঞানহীনের পরিচয় দিলেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।
গরমের মৌসুমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে পানির সংকট। আর এর মধ্যেই কাউকে দায়িত্ব হস্তান্তর না করে ছুটি নিয়ে তিন মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন ওয়াসার এই এমডি।
কাউকে দায়িত্ব না বুঝিয়েই ছুটিতে এমডি
তাকসিম এ খানের ছুটির আদেশে বলা হয়েছে, এ সময় পরিচালক (উন্নয়ন) এমডির দায়িত্বে থাকবেন। তবে তিনি নিজেই অফিস আদেশ জারি করে নিজেকে অনলাইনে এমডির দায়িত্ব দিয়ে উড়োজাহাজে চেপে বসেছেন।
চিকিৎসা এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তিনি এ ছুটি নিয়েছেন। ওয়াসার জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল ২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তাকসিম এ খান।
এদিকে পানির অভাবে ধুঁকছে রাজধানী। এই সময়ে ওয়াসার এমডির দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংস্থাটিরই কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের ছুটিতে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে কাউকে ভারপ্রাপ্ত বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তাকসিম এ খান কোনোটাই করেননি।
ওয়াসার এমডি স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশ অনুযায়ী, ২৫ এপ্রিল থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত তিনি ছুটি কাটাবেন। কোনও কারণে ওই সময়ে ছুটি কাটাতে না পারলে যাত্রার তারিখ থেকে পরের তিন মাস ছুটি কার্যকর থাকবে।
ওই অফিস আদেশে বলা হয়, বিদেশে অবস্থানের সময় যেকোনো পলিসি এবং অন্যান্য বিষয়ে তাকসিম এ খান নিজে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করবেন। এর জন্য ই-নথি, ই-জিপি, ই-মেইল, ফেসটাইম, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করবেন।
তাকসিম এ খান যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময়ে সংস্থার সব বিভাগীয় প্রধান নিজ নিজ রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন বলে ওয়াসার অফিস আদেশে বলা হয়। সার্বক্ষণিক যেকোনো প্রয়োজনে সরাসরি এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেম এমডির পক্ষে বিভিন্ন সভায় প্রতিনিধিত্ব এবং রুটিনকাজ করবেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পানি সরবরাহ) মুহম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী, এমডির দায়িত্বে থাকবেন ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেম। আমাদের যোগাযোগ হবে আবুল কাশেমের সঙ্গে।’
তিনি বলেন, ‘তাকসিম এ খানের জারি করা অফিস আদেশ দেখিনি। এটা তার ইন্টারনাল ব্যাপার। আবুল কাশেম যেকোনো বিষয়ে তাকসিম এ খানের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন, কথা বলতে পারেন। কিন্তু তাকসিম এ খান দায়িত্বে থাকবেন না।’
জানা যায়, এর আগে ২০১৯ সালের ১১ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন তাকসিম এ খান। সেবারও একই কাজ করেছিলেন ওয়াসার এমডি। যুক্তরাষ্ট্রে বসেই নথিপত্রে স্বাক্ষরসহ সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। আর যাকে রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার কাজ শুধু চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তাকসিম এ খানের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক
২০০৯ সালে প্রথম দফায় নিয়োগ পাওয়ার পর আর পদ ছাড়তে হয়নি তাকসিম এ খানকে। নাগরিক সেবার মান নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও নানা বিতর্কের মুখে পড়লেও ওয়াসার এমডি পদে দফায় দফায় নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।
ষষ্ঠবারের মতো তাকসিমকে ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয় গত ১ অক্টোবর। প্রতিবারই তার নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও ওঠে।
সূত্র মতে, প্রথমবারের নিয়োগসংক্রান্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এমডি নিয়োগের জন্য ওয়াসা বোর্ড ২০০৯ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে অথবা সিনিয়র পর্যায়ে সাধারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০ বছরের আবশ্যিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।
ওই সময় এই পদের জন্য তাকসিম এ খানের জমা দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময়ের ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাকসিমের সখ্য থাকায় মৌখিক পরীক্ষায় তাঁকে সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয়।
ঢাকা ওয়াসার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় এমডি পদে থাকার ইতিহাস গড়া তাকসিম এ খান প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিধিসম্মতভাবে কাউকে ছয় দফা নয়, আরও বেশি নিয়োগ দিলেও টিআইবির আপত্তি নেই। কিন্তু তাকসিম এ খানের নিয়োগটি বিতর্কিত। প্রথমবার নিয়োগ দেওয়ার সময় বিজ্ঞপ্তিতে যে যোগ্যতা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল, তা তাকসিম খানের ছিল না। তাঁর পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি মানা হয়নি।
দুর্নীতির অভিযোগ দুদকের
বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধে আদালতের রায় ও আদেশ বাস্তবায়ন না করায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের ভূমিকা নিয়ে এ বছরের শুরুতেই প্রশ্ন তোলে আদালত।
আদালত জানায়, আদালত বলেছে, রায় বাস্তবায়নে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদক্ষেপ খুবই ধীরগতিসম্পন্ন। এভাবে চলতে থাকলে বুড়িগঙ্গার দূষণ কোনোদিন বন্ধ হবে না, বরং রায় অকার্যকর হয়ে যাবে।
ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, ঘুষ লেনদেন, পদ সৃষ্টি করে পছন্দের লোককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোককে ওএসডি করাসহ বিস্তর অভিযোগ আছে। গত বছর ওয়াসার ১১টি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াসার প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না। নানা প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের নকশা ও বিবরণ অনুযায়ী কাজ করা হয় না। প্রকল্পে পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন কিছু শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে নির্দিষ্টসংখ্যক ঠিকাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন।
এ ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং কাজ পাওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বর্তমানে একটি প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুদকের প্রতিবেদন বলছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ