ধর্মীয় চরমপন্থা ও সন্ত্রাস মোকাবেলায় পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও ধর্মীয় চরমপন্থা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কার্যক্রমের প্রসংশা করেছে ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (ইএফএসএএস)।
ব্যাপক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি মন্তব্য প্রতিবেদনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বীকৃত সংস্থাটি বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিবেশী পাকিস্তান যেখানে চরমপন্থি ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহ, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেখানে এদের দমনে বাংলাদেশের ভূমিকা যথেষ্ট ইতিবাচক।
‘বাংলাদেশ অ্যান্ড পাকিস্তান: অ্যাকটিং এগেইনস্ট এক্সট্রেমিজম ভারসাস মেকিং এ শো অব অ্যাকটিং এগেইনস্ট এক্সট্রেমিজম’ শিরোনামে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কট্টরপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম ও পাকিস্তানের কট্টরপন্থি তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) কার্যক্রম তুলে ধরে ইএফএসএএস বলেছে, এসব গোষ্ঠী এই দুই দেশে সরকারের উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি করেছে। নিজ নিজ দেশের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সহিংস ও প্রাণঘাতী বিক্ষোভে জড়িয়েছে।
ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় অলাভজনক সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় পরিচালিত সহিংস বিক্ষোভের পর সরকার হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালায়। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের ক্ষোভ কমাতে হেফাজত তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
অথচ পাকিস্তানে টিএলপি সেদেশ থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক করতে তাদের সরকারকে বাধ্য করেছে। ফ্রান্সে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ক্যারিকেচার প্রচারের পর সম্প্রতি ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে রাজপথে নামে টিএলপি।
ইএফএসএএস বলছে, এটা প্রমাণিত যে, যেখানে শেখ হাসিনার সরকার কট্টরপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী হেফাজতকে মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে, সেখানে পাকিস্তান এ ব্যাপারে নাটকীয় সংকটে পড়ে ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি এবং টিএলপির মতো গোষ্ঠীকে মোকাবেলায় দুর্বল বিবেচনা ও দুর্বল পদক্ষেপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে।
আমস্টারডামভিত্তিক এই নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট আশাবাদী যে শেখ হাসিনার সরকার এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম।
ইএফএসএএস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এই দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মোকাবেলা করতে আলাদা আলাদা নীতি বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি অবশিষ্টাংশের প্রভাব ছিল তখন উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত ও আশ্রয় দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত এক দশক দেশটি একটি শক্তিশালী এবং ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাসবিরোধী সরকার দেখেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী ও চরমপন্থীদের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকার অবিচল প্রত্যয় প্রকাশ করেছে।
গত বছর অক্টোবরে ফ্রান্সে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে মহানবীর কার্টুন প্রদর্শনের কারণে মুসলিম শিক্ষককে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ধর্ম বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থনে করা মন্তব্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ দেখায় হেফাজত ও টিএলপি।
বিক্ষোভে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি পণ্য বর্জনে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়।
টিএলপির মুখপাত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলেছে, ফরাসি পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের পর ১৭ নভেম্বর কট্টরপন্থী গোষ্ঠীটি তাদের আন্দোলনের ইতি টানে।
একই সময়ে বাংলাদেশে হেফাজতের কয়েক হাজার কর্মী ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে সে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু পাকিস্তানে টিএলপি থেমে থাকেনি। একই দাবিতে বিক্ষোভের মধ্যে সহিংসতায় কমপক্ষে চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তান সরকার তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি এতোটাই অবনমন হয় যে এক পর্যায়ে ১১ কর্মকর্তাকে জিম্মিও করে টিএলপি।
চরমপন্থিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পার্লামেন্টে তোলা ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের প্রস্তাবের ওপর গত সপ্তাহে আলোচনা শুরু করে পাকিস্তান সরকার।
ফরাসি নাগরিকদের সাময়িকভাবে পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ‘সেদেশে ফ্রান্সের স্বার্থ হুমকির মুখে’ বলে সতর্ক করা হয়।
গত ১৯ এপ্রিল আল জাজিরা তাদের এক রিপোর্টে এক বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে কোট করে। সেখানে তিনি বলেছেন, হেফাজতের প্রভাবশালী নেতাসহ কয়েকশ সদস্য ও সমর্থককে গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। হেফাজতের যুগ্ম সম্পাদক মামুনুল হক ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে আটক হন।
তার আটকের পর ঢাকার এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেছেন, হকের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ আমরা তদন্ত করব। সে সহিংসতায় প্ররোচনা দেওয়ার বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িত।
সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় এবং সমন্বিত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে যে হেফাজতের চরমপন্থী রূপ ধারণের সম্ভাবনার দিকে সরকারের জ্ঞান আছে। তাই হাসিনা সরকার স্পষ্ট ছিল যে হেফাজতকে প্রত্যাখ্যান করা দরকার।
অন্যদিকে, পাকিস্তান এই সপ্তাহে উগ্র ইসলামপন্থী সংগঠন তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান (টিএলপি) দ্বারা সহিংস বিক্ষোভ সামাল দিতে বিভ্রান্তি এবং ভুল অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের হেফাজতের মতোই, টিএলপি পাকিস্তানে শরিয়া আইন প্রয়োগের পক্ষে এবং দেশটির ব্লাসফেমি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের দাবি জানাচ্ছে। টিএলপির দাবী যে পাকিস্তান সরকার ২০ এপ্রিলের মধ্যে ফরাসী রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করার জন্য টিএলপির সাথে একটি চুক্তি করেছিল। তা না করে সরকার টিএলপি নেতা সাদ হুসেইন রিজভীকে আটক করে।
সরকারের বিচার ও দৃষ্টিকোণের অভাব পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। পাকিস্তানিরা তাদের টিভি স্ক্রিনে দেখছিল ভয়াবহতার সাথে সরকার হোঁচট খাচ্ছে এবং টিএলপির কাছে পরাজিত হয়েছে। হতবাক বাস্তবতা হ’লো পাকিস্তান সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী নুরুল হক কাদরী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ গত নভেম্বরে এই চরমপন্থী দলের সাথে একটি চুক্তি সই করেছিল।
এতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের একটি বিল ২০ এপ্রিলের মধ্যে সংসদে উত্থাপন করা হবে।
চুক্তি স্বাক্ষর এছাড়াও পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে রায় এবং দূরদর্শিতার একটি বিশেষ অভাব প্রতিফলিত করে। এই বৈশিষ্ট্যগত বিভেদ থেকে শুরু হয়েছিল যা দীর্ঘদিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাসবাদীদের এবং চরমপন্থীদের দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করার এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছিল। দূরদর্শিতার অভাবে প্রথম বিষয়টি ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করার ধারণাটি বিবেচনা করতে সম্মত হওয়া এবং তারপরে পাঁচ মাস দূরে একটি তারিখ নির্ধারণ করে। সরকারের এসব কাজ টিএলপির প্রত্যাশাই বাড়িয়েছে। ফলস্বরূপ, পাকিস্তান নির্ভীকভাবে সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নৈতিক দৃঢ়তা হারিয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের নতুন ঢেউ এবং রুগ্ন অর্থনীতির পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রশাসন কতোটা নাজুক অবস্থানে আছে তা পার্লামেন্টে ওই প্রস্তাব তোলার পদক্ষেপ দেখেই বুঝা যায়।
“পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান যে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে এটাতে সে ইঙ্গিতও মেলে।”
ফ্রান্সে কার্টুন প্রদর্শনের জেরে পাকিস্তানে টিইএলের ২৬ বছর বয়সী নেতা সাদ হুসাইন রিজভি বিক্ষোভের ডাক দেওয়ার পর গ্রেপ্তার হন।
ওই ঘটনা তুলে ধরে ইএফএসএএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিএলপি বেরেলভির ইসলামি মতাদর্শ অনুসারীদের সমর্থনপুষ্ট, পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই মতাদর্শ সমর্থন করে।
আর বাংলাদেশে হেফাজত মূলত কওমি মাদ্রাসানির্ভর সংগঠন, যারা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শ অনুসরণ করে।
বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর হেফাজত ২৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। একই দিন কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বোর্ড এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত হলেও মামুনুলের বড় সমর্থক হেফাজতের আমির জুনাইদ আহমদ বাবুনগরী এখনও এই গোষ্ঠীর শীর্ষ পদেই আছেন। নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিও করা হয়েছে তার মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর নেত্বেত্বে। ফলে হেফাজত শেষ পর্যন্ত টিএলপির পথ ধরবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ