করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাব কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ। গত বছরের ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখনও বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ওই সময় দেশে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছিল। নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সেই ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সামাল দিতে গত ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। এরপরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় গত ১৪ এপ্রিল থেকে সার্বিক কার্যাবলি ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে সর্বাত্মক লকডাউন। এতে জরুরি পণ্য ও সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত কার্যক্রমের বাইরে সবকিছু বন্ধ রাখা হয়েছে। এই লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এতে দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়েছেন নতুন করে।
সেই সূত্র ধরেই ভয়ঙ্কর একটি তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি শেষ হওয়া একটি সমীক্ষা থেকে। করোনার প্রভাবে এবার নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। তবে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ৪৪ শতাংশ।
আজ মঙ্গলবার(২০ এপ্রিল) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘পভার্টি ডায়নামিকস অ্যান্ড হাউসহোল্ড রিয়েলিটিস’ শীর্ষক এই জরিপের (প্রথম পর্ব) ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন।
জরিপে যারা সাধারণত দারিদ্র্যসীমার ওপরেই বসবাস করেন, কিন্তু যেকোনো অভিঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারেন, তাদের নতুন দরিদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ৪৪ শতাংশ। এ হিসাব থেকে জাতীয় পরিসরে নতুন দরিদ্রের এ হিসাব (১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ) প্রাক্কলন করা হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোভিডের আঘাত সব জায়গায় একইভাবে অনুভূত হয়নি। শহরের তুলনায় গ্রামে তার প্রভাব কমই দেখা গেছে। সে কারণে শহরের বস্তিবাসীর জীবন গ্রামের শ্রমজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত।
জরিপের তথ্য থেকে তিনি জানান, গত বছর ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান, যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনো ফেরেনি। প্রাক-কোভিড সময়ের তুলনায় শহরের বস্তিবাসীর আয় কমলেও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় গত জুনের তুলনায় এ বছরের মার্চে দ্বিগুণ হয়েছে।
তিনি মনে করেন, ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমেছে আশ্চর্যজনকভাবে। অরক্ষিত অদরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার সামগ্রিকভাবে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে দেশের কৃষি খাত অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছে বলে উল্লেখ করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, কেবল কৃষক ছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী বাকি সব পেশার মানুষের আয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় কমেছে। কিন্তু পুনরুদ্ধারের কথা যখন বলা হয়, তখন মূলত সামষ্টিক অর্থনীতির বড় বড় খাত, যেমন তৈরি পোশাক খাতের কথাই উল্লেখ করা হয়। জাতীয় পরিসরে কৃষির কথা সেভাবে উচ্চারিত হয় না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা ও লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন দিনমজুর, শ্রমিক ও নিম্নবিত্ত জনগণ। বিশেষ করে যারা শহর ও শহরের উপকণ্ঠে থাকেন। এ পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক খাতের লোকজন রিকশাচালক, পরিবহনকর্মী, হকার, দিনমজুর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কামার, কুমোর, জেলে, দর্জি, বিভিন্ন ধরনের মিস্ত্রি, নির্মাণ শ্রমিকসহ দৈনন্দিন আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। সামগ্রিকভাবে কৃষি, শিল্প ও সেবা সব খাতেই নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর লকডাউনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আয় হারিয়ে কর্মহীন বসে থাকার ফলে এ ধরনের মানুষের খাদ্য সংকট ছাড়াও স্বাস্থ্য ও মানসিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতিরও আশঙ্কা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদরা লকডাউনের সময় দরিদ্রদের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তারা বলছেন, শহরের দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিত্তবানদের সহায়তা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। লকডাউন-পরবর্তী সময়ে এ ধরনের লোকেরা যাতে সহজেই আয় করতে পারে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা বলছেন তারা।
এরই মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকার লকডাউনে দরিদ্র মানুষের সহায়তায় বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তবে কবে কখন কীভাবে এসব সহায়তা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত ঘোষণা আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে।
মন্ত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সোয়া কোটি পরিবারকে ১০ কেজি চাল, এক কেজি করে ডাল, তেল, লবণ ও চার কেজি আলু দেওয়া হবে। ৩৬ লাখ পরিবারকে নগদ আড়াই হাজার টাকা করে দেবে সরকার। এক লাখ কৃষককে পাঁচ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বাড়ানো হয়েছে খোলা বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি। চালু করা হচ্ছে বিশেষ ওএমএস। দেশব্যাপী ৭৫ হাজার টন চাল ১০ টাকা দরে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। টিসিবির মাধ্যমেও বিক্রি বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের কর্মসূচি দ্রুত পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে সরকারের এ কার্যক্রম পর্যাপ্ত নয়। কারণ, সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছে কিছু মানুষ, যারা আগে থেকেই বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে দরিদ্র ও দুস্থ হিসেবে নিবন্ধিত। কিন্তু যাদের সংকটাপন্ন পরিস্থিতির তথ্য সরকারের কাছে নেই, তাদের সহায়তা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। গত বছরের সাধারণ ছুটির সময় দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেড়েছে। তাদের কারও কারও অবস্থার উন্নতি ঘটলেও নতুন করে লকডাউনের ফলে অনেকেই ফের দরিদ্রের তালিকায় ফিরে গেছেন। এ ধরনের মানুষের জন্য সরকারের সহায়তা আরও বাড়ানো দরকার, বিশেষ করে তাদের নগদ টাকা দেওয়া দরকার।
তারা বলেন, কিছু শিল্পকারখানা ছাড়া এখন সবই বন্ধ। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক খাতের লোকদের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা শহরেই বেশি। নতুন করে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়েছে। সরকারকে এসব বিষয় মাথায় নিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। এলাকাভিত্তিক অ্যাসেসমেন্ট করে সহায়তা করা যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ