শুভ্র সরকার : ঘুরে আসা যাক এখন থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে। ঘরভর্তি গমক্ষেত। অল্প হাওয়ায় কিশোরীর বেণী করা চুলের মতো দুলছে শীষগুলো। টুপ করে একটা নক্ষত্রের পতন। তবে পতন বলা যাবে কিনা, এই নিয়ে ঢের সন্দেহ বাক-বিতণ্ড তর্ক করা যেতে পারে। তবে যা করা যায় না তা হলো অস্বীকার। বিষণ্ণতার শ্রেষ্ঠ জাদুকর প্যারিস থেকে কয়েক মাইল দূরের ছোট্ট বসতি ওভের-সুর-ওয়াজে ১৮৯০ সালের ২৯ জুলাই র্যাভো-ইন সরাইখানার চিলেকোঠার ঘরেই রাত ১টা নাগাদ, ২৯ ঘণ্টার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেন বিখ্যাত চিত্রকার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ।
জীবদ্দশায় মাত্র একটি ছবিই বিক্রয় করতে পেরেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। রেড ভাইনইয়ার্ড নামের ছবিটিই ভিনসেন্টের নিজ হাতে বিক্রয় করে যাওয়া একমাত্র ছবি।
বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৭ বছর। বয়সের থেকে আরও ছোট্ট এক শিল্পী জীবন। কারণ অন্যদের মতো ছোট থেকে কখনোই তুলি ধরেননি ভ্যান গঘ। ২৭ বছর বয়সে হয়েছিলেন ঘরছাড়া। এরপর আর কোন ঘর খোঁজেননি। আশ্রয় নিয়েছিলেন আঁকার কাছে। তার নিজস্ব জগৎ বাঙালীর কাছে যতটা সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত, তার থেকেও কয়েকগুণ সুন্দর।
রং-তুলি-ইজেল আর ক্যানভাসের পৃথীবীতে কাটিয়েছেন মাত্র ১০ বছর। এই ছোট্ট সময়েই প্রায় ২১০০ ছবি এঁকেছেন ভ্যান গঘ। যার মধ্যে অধিকাংশ জীবনের শেষ দু-তিন বছরে। তারপরেই মৃত্যু। এই মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া মিথ কমলকুমারের গদ্যের মতো রহস্যময়। তবে সত্যিই কি আত্মহত্যা করেছিলেন ভিনসেন্ট? নাকি হত্যা করা হয়েছিল তাকে?
মানসিকভাবে অসুস্থ ভ্যান গঘ
ছোটো থেকেই একদম আলাদা ছিলেন। বাকি ভাই-বোনদের মতো ছিলেন না ভিনসেন্ট। একাকিত্ব ছিল তার সব সময়ের সঙ্গী। ছোটো থেকেই একের পর এক ঘটনায় তার ভেতরে বাসা বেঁধে ছিল বিষণ্ণতা। যা তার সাথে ছিল মৃত্যুর আগ অব্দি। এমন খাতির সচরাচর দেখা যায় না। কোনো সিদ্ধান্তে মনস্থির করতে পারতেন না ভিনসেন্ট। আর যার জেরে বারবার উপার্জনের ঠিকানা বদলাতে হয়েছে তাকে। অদ্ভুত আচরণের জন্য শত্রু হয়েছেন মানুষের। সহ্য করেছেন নিপীড়ন।
জীবনের বড় অংশে জুড়েই ভ্যান গগ মানসিক অসুস্থতায় ভুগেছিলেন। বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে দিন কাটিয়েছিলেন এই স্বনামধন্য চিত্রকার। পরবর্তীতে জানা যায় দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা, মানসিক ভ্রান্তি জীবনের পুরাটা সময় লেগে ছিল ভিনসেন্টের পেছনে। আধুনিক সাইকিয়াট্রিস্টদের ধারণা তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়া, সিফিলিস, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, হাইপার-গ্রাফিয়া, ম্যানিক-ডিপ্রেশন, টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির মত মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
এছাড়াও টাকার অভাবে খাদ্যাভাবের জন্যও বেশ দুর্বল ছিলেন ভ্যান গগ। মূলত মানসিক ও শারীরিক দু’ভাবেই বেশ অসুস্থ ছিলেন এই চিত্রশিল্পী। ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় হওয়া ছবি থাকলেও নিজের জীবনে পুরোটা সময়ই দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো ভ্যান গগকে। সত্যিকার অর্থে জীবদ্দশায় মাত্র একটি ছবিই বিক্রয় করতে পেরেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। রেড ভাইনইয়ার্ড নামের ছবিটিই ভিনসেন্টের নিজ হাতে বিক্রয় করে যাওয়া একমাত্র ছবি।
কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন গণিকাকে!
যে সমস্ত পাগলামোর মিথ বাতাসে এখনও গন্ধ ছড়ায় তার একটা গঘের কান কেটে ফেলা। একবার ভাবুন কী সর্বনাশের কথা। এতকিছু থাকতে কান!
তবু কথিত আছে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ নিজের কান নিজে কেটে ফেলেছিলেন! আর ভ্যান গঘের কান কাটা নিয়ে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে জনপ্রিয় গল্পটি ছিল যে, পল গাউগুইনের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েই রেজর দিয়ে নিজের কান কেটে ফেলেন তিনি।
ছোট ভাই থিও ভ্যান গগের ভাষ্যমতে, তার জীবনের শেষ বাক্যটি ছিল ‘লা ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস’। যার ইংরেজিতে অনুবাদ ‘This sadness will last forever’।
পরবর্তীতে সেটি র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে যৌনপল্লির এক মহিলার কাছে তা পাঠিয়ে দেন। যে মহিলার নিকট ভ্যান গঘ ও পল গাউগুইন দুজনেরই যাতায়াত ছিল।
আরেক ভাষ্যমতে, পল গাউগুইন নিজ হাতেই ভিনসেন্টের কান কেটে ফেলেন। এটা শুনতে বেশি ভালো লাগে। অন্তত নিজেই নিজের কান কাটার থেকে কম ভয়াবহ শোনায়। আর সেই কান কাটার ঘটনার পরই পল গাউগুইনের সাথে বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে তার। তাই সবার ধারণা, কান কর্তনের সাথে পল গাউগুইন সরাসরিই জড়িত।
কেউ আবার বলেন, ভাই থিও বিয়ে করছেন শুনে নাকি কান কেটেছিলেন গঘ! তবে কোনোটির বিষয়েই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাগলামির কারণে ছন্নছাড়া ভ্যান গঘ
বিষণ্ণ, ঘাড়ত্যাড়া, জেদি ভিনসেন্টের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কে জড়াইনি কেউ। আর্লের সেই হলুদ বাড়িতে পল গঁগ্যা ছিলেন কিছুদিন তার সঙ্গে। কিন্তু শেষমেশ ভিনসেন্টের পাগলামিতে ভীত, সন্ত্রস্ত হয়েই তিনিও ছেড়েছিলেন সেই বাড়ি। তারপর থেকেই চাউর হয়ে গিয়েছিল গঘের পাগলামো। সেই রাতেই ভ্যান গঘ তার কান কেটে কাগজে মুড়ে উপহার দিয়ে এসেছিলেন এক গণিকাকে।
এজন্য বেশ কিছুদিন হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন তিনি। যখন ছাড়া পেলেন, হলুদ বাড়িতে ফিরে আর থাকা হলো না খুব বেশিদিন। আর্লের লোকজন পাগল বলেই এক প্রকার তাড়ানোর মতলব করেছিল তাঁকে।
এরপর ভিনসেন্ট নিজেই আর্ল ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন এক অ্যাসাইলামে। সেখান থেকে কয়েক মাস পরে ছাড়া পেয়ে ওঠেন ওভের-সুর-ওয়াজের র্যাভো-ইনে। প্রথমে গ্রামের মানুষ তাকে আপন করে নিলেও খুব বেশিদিন চাপা থাকেনি তার পাগলামির খবর।
মৃত্যু যার জীবনের থেকে আভিজাত্যের
তবুও ভিনসেন্ট জানতেন, শুধু ছবি আঁকাই তাকে আশ্রয় দিতে পারে। তবে বুনো হিংস্র রাগটা নিজের ওপরেই ফিরে এসেছিল আবার। দিনটা ছিল ২৭ জুলাই। রাগে ক্ষোভে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলেন র্যাভো-ইনের চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটি। নিজের স্টুডিও। তারপর সেই সরাইখানা থেকে বেরিয়ে গমক্ষেতের পাশের রাস্তা ধরে মিলিয়ে গিয়েছিলেন ভিনসেন্ট।
“অন্তত দেড় ফুটেরও বেশি দূরত্ব থেকে গুলি চলেছিল সেই বন্দুক থেকে। অর্থাৎ ভ্যান গঘ নিজে চালাননি সেই বন্দুক।”
খানিক বাদে আকাশ ফাটানো একটা শব্দে সম্বিত ফিরে ছিল সকলের। বলা হয়, একটি গম ক্ষেতে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের বুকে গুলি চালান। গুলি করার আগ মুহূর্তে গমের ক্ষেতে বসেই ছবি আঁকছিলেন তিনি। বুকে হাত চেপে ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে চলে এসেছিলেন ভিনসেন্ট। পাঁজরের ধার ঘেঁষে লাল রঙে কাঁপা কাঁপা হাতে কেউ একটা গমক্ষেত আঁকতে চেয়েছিলো যেন। অসহ্য এক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিলে রঙ তুলিতে বিষণ্ণতার ঈশ্বর ভ্যান গঘ।
এরপর কেটে যায় ২৯ ঘণ্টা। প্যারিস থেকে ছুটে এসেছিলেন তাঁর ভাই থিও। চিকিৎসক এসেছিলেন। কিন্তু সফল হয়নি প্রাণ ফিরিয়ে দিতে। শুধু থিও হাতে হাত রেখে বসে ছিলেন শেষ মুহূর্ত অবধি। বারবার জিজ্ঞেস করার পরও ভাই থিওকে বলেছিলেন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘আমার দেহ, আমি যা ইচ্ছা করতে পারি’। তাহলে বিতর্ক কীসের?
ছোট ভাই থিও ভ্যান গগের ভাষ্যমতে, তার জীবনের শেষ বাক্যটি ছিল ‘লা ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস’। যার ইংরেজিতে অনুবাদ ‘This sadness will last forever’।
আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা!
ভ্যান গঘের মৃত্যু এখনও অব্দি এক রহস্য। যা চারপাশে গঘের জীবনের ছোট ছোট সব মুহূর্ত সাজিয়ে তার মৃত্যুর সত্য উন্মোচনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন গবেষকরা। এমনই দুজন গবেষক গ্রেগরি হোয়াইট স্মিথ এবং স্টিভেন নাইফ। সম্প্রতি তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মত পেশ করেছেন ভ্যান গঘের মৃত্যু প্রসঙ্গে বা বলা ভালো, প্রমাণ দিয়েছেন।
২০১৩ সালে এই দুই গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন ভ্যান গঘ মিউজিয়ামে। এক কিউরেটর সমস্ত তথ্যগত বিশ্লেষণ দেখে জানিয়েও ছিলেন, ‘ভিনসেন্টের মৃত্যু এভাবেই হয়তো হয়েছিল। আমরা উপযুক্ত প্রমাণ দিতে সক্ষম হইনি। তবে এই গবেষণা সত্যি হলেও বিশ্বাসযোগ্য না। কারণ, মানুষের মাথায় সেই বুলেটের মতই গেঁথে রয়েছে আত্মহত্যার মিথ।’
ভিনসেন্ট দীর্ঘদিন ধরেই খরচের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন। কারণ থিও, যে ভাই তার সমস্ত আঁকার খরচ বহন করতেন, তার আর্থিক অবস্থা তখন বেশ খারাপের দিকে। অন্যদিকে বাড়ছিল ভিনসেন্টের নিজের খরচও। পাশাপাশি সংসারী হয়েছেন থিও। ঘরে এসেছে সদ্যোজাত অতিথি। এসবের মধ্যেই ভিনসেন্টের আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক নয়।
কিন্তু আত্মহত্যা করতে হলে তিনি নিজের স্টুডিওতেই করতে পারতেন। মদ্যপ অবস্থায় গমক্ষেতের দিকে তার চলে যাওয়া কেন? দ্বিতীয়ত, যদি আত্মহত্যাই করা তার উদ্দেশ্য ছিল, তবে গুলি চালানোর পরে তিনি আবার ফিরে এলেন কেন সরাইখানায়? নিজেকে শেষ করার উদ্দেশ্য থাকলে কি দ্বিতীয় গুলি তিনি চালাতেন না?
অভিশপ্ত পিস্তল ও ব্ল্যাক পাউডার
গবেষণা শুরু করতে এক নতুন চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। নাম রেনেয়া সেক্রেটান। ভ্যান গঘের কান এবং তার পাগলামি প্রায়শই ছিল যার ঠাট্টার উপাদান। তার বাবা ছিলেন প্যারিসের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি। বাবার থেকেই জোগাড় করেছিলেন একটি বাতিল পিস্তল। কারণ নিজেকে ‘কাউবয়’ হিসাবে দেখতে পছন্দ করতেন রেনেয়া। এমনকি জুতো, টুপি পরে কাউবয় সেজেই ঘুরে বেড়াতেন তিনি সুর-ওয়াজে।
ভিনসেন্টের মৃত্যুতে ব্যবহৃত পিস্তলটি এই রেনেয়ার। উল্লেখ করেছিলেন, ‘যখন ব্যবহৃত হতে চেয়েছে, তখনই ঝলসে উঠেছিল এই পিস্তল’। তবে পুলিশের কোনো তথ্যেই কোনো রেকর্ড নেই এই ঘটনার। হয়তো তার বাবা একজন প্রভাবশালী আর্মি অফিসার ছিল বলেই। মজা আর উত্যক্ত করার ছলেই কি সেদিন ট্রিগারে চাপ দিয়েছিল রেনেয়া? আর গুলি ছুটে গিয়েছিল ভিনসেন্টের পাঁজরের দিকে?
গমক্ষেতের কাছে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না কেউই। ভিনসেন্ট ফিরে আসার পর যারা সামনে থেকে দেখেছিলেন তাঁদের কথা ভিত্তিতেই রিপোর্ট নেওয়া হয়েছিল ভিনসেন্টের মৃত্যুর। জানা যায় ভিনসেন্টের যেখানে গুলি লেগেছিল সেই ক্ষতস্থানের চারিদিকে দুটি বৃত্তাকার দাগ দেখা গিয়েছিল। একটি কালচে বেগুনি এবং অন্যটি বাদামি। তার ভিত্তিতেই অনেক ঐতিহাসিকরা লিখেছিলেন বুকে ঠেকিয়েই গুলি চালিয়েছিলেন ভিনসেন্ট। বুলেটের আঘাতে ওই বেগুনি বলয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। এবং বাদামি বলয়টির জন্য দায়ী বারুদের জ্বলন।
গ্রেগরি হোয়াট আর স্টিভেন নাইফে এই বিষয়টির ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পেতে ইয়র্কের ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ ডি মায়োর কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন ২০১২ সালে। ডি মায়ো বর্ণনা শুনে উদাহরণও দেখিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, বুলেটের জন্য দেহে কোনো শিরা ছিঁড়ে গেলে এমন ঘটনা ঘটে। বুলেটবিদ্ধ হওয়ার পরও যাঁরা দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকেন। তাঁদের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এই উপসর্গ দেখা যায়। আর বাদামি সেই বলয়টিও অস্বাভাবিক কিছুই না।
এদিকে ১৮৮৪ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল ‘স্মোকলেস গানপাউডার’। ১৮৯০ সাল নাগাদ ফ্রান্সের সেনা বাহিনীর অধিকাংশের কাছেই আসেনি এই আধুনিক বারুদের বন্দুক। তার আগে অব্দি বন্দুকে ব্যবহৃত হত ‘ব্ল্যাক পাউডার’ নামের একটি বারুদ। কাছ থেকে যদি সেই বারুদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে ভিনসেন্টের দেহে একটি মাত্র ছিদ্র থাকার কথাই নয়। বরং তার আশেপাশের অংশও ঝলসে যাওয়ার কথা। কিন্তু এমন তথ্য উল্লেখ নেই কোথাও।
ডি মায়ো এর মতে, অন্তত দেড় ফুটেরও বেশি দূরত্ব থেকে গুলি চলেছিল সেই বন্দুক থেকে। অর্থাৎ ভ্যান গঘ নিজে চালাননি সেই বন্দুক।
“ভ্যান গঘ: দ্য লাইফ”
এই বইটিই পাল্টে দেয় গঘের মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত ধারণা। সম্প্রতি প্রকাশিত এই বইটির লেখক সেই গবেষক স্টিভেন নাইফে এবং গ্রেগরি হোয়াইট স্মিথ৷
তাদের দাবি, আত্মহত্যা নয়, পরিচিত দুই বালকের গুলিতেই মৃত্যু হয় ভ্যান গঘের৷ ২০ জন অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে প্রায় ১০ বছরের গবেষণা ও ভ্যান গঘের লেখা হাজার খানেক চিঠি তুলে ধরে এই দুই লেখক জানান, আদতে বিখ্যাত এই ওলন্দাজ চিত্রকরের মৃত্যু ছিল একটা দুর্ঘটনা৷
নেদারল্যান্ডস’এর ভ্যান গঘ মিউজিয়াম’-এর কিউরেটর লেও ইয়ানসেন এ ঘটনাকে একাধারে মনোজ্ঞ এবং নাটকীয় বলে উল্লেখ করলেও, নাইফে ও স্মিথ জানান, সে সময় প্যারিস থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে ওভ্যার-সুর-ওয়িস নামের একটি গ্রামে জীবনযাপন করছিলেন ভ্যান গঘ। বাস করছিলেন ওব্যার্জ রাভো নামের একটি বাড়িতে৷ শোনা যায়, প্রায়শই বাড়িটির অদূরে গম ক্ষেতে হাঁটতে যেতেন ফান গখ৷ আঁকতেন তার সেই বিখ্যাত ‘ব্রাশ-স্ট্রোক’-এর অনবদ্য সব ছবি৷
ভ্যান গঘ যে দিন মারা যান, তার ঠিক আগের দিনটা ছিল সে রকমই একটা ঝকঝকে দিন৷ সেদিনও গম ক্ষেতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন চিত্রকর৷ কাছেই ১৬ বছরের কিশোর রেনে সেক্রেটান ও তার বন্ধুরা ‘কাউবয়’ সেজে নিজেদের মধ্যে খেলা করছিল৷ তাদের সঙ্গে ছিল একটি ত্রুটিপূর্ণ বন্দুক৷ হঠাৎ করে খেলার ছলেই গুলি বেরিয়ে যায় এবং একটা গুলি গিয়ে লাগে ভ্যান গঘের পেটে৷ আহত হন তিনি৷ এবং পরের দিন মৃত্যুবরণ করেন৷
নাইফে জানান, ‘‘সেক্রেটান সচেতনভাবে শিল্পীকে গুলি করেনি৷ সে সময় ভ্যান গঘসহ সকলেই মাতাল ছিল৷ তাছাড়া, আমরা নিশ্চিৎ যে নিজেকে গুলি করার পরিকল্পনা নিয়ে ভ্যান গঘ ক্ষেতে যাননি৷ আত্মহত্যা করার কোনো বাসনাই তার ছিল না৷”
আহত ভ্যান গঘ বাড়ি ফিরে গিয়ে ঘটনাটির দায় নিজের ওপর টেনে নেন৷ নিজেকে নিজেই গুলি করেছেন বলে ঘোষণা করেন৷
গ্রেগরি স্মিথ জানান, ভ্যান গঘ মৃত্যু চেয়েছিলেন এমন নয়৷ তবে মৃত্যু যখন তার সামনে এসে হাজির হল, তখন তিনি তাকে স্বাগত জানান৷ আসলে সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল নব্য-ধারার এই শিল্পীর৷ কোনো ছবিই বিক্রি হচ্ছিল না৷ ভ্যান গঘের সমস্ত দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ছোটভাই থেও-র ওপর৷ তাই সম্ভবত, ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও নিজের খরচ বহনের চাপ থেকে তাকে মুক্তি দিতেই একা ঘরে মৃত্যুবরণ করেন ভ্যান গঘ।”
ভ্যান গঘের সেই মৃত্যু ঘিরে আজও হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে একলা সাইপ্রেস। এদিকে মৃত্যুর বছরেই তার আঁকা ছবি ‘দ্য রেড ভাইনইয়ার্ড’ চারশো ফ্র্যাঙ্কে বিক্রি হওয়ায় খুশি হয়েছিলেন ভিনসেন্ট। ভাই থিওকে চিঠিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন স্বপ্নের কথা। ‘আমি আশাবাদী প্যারিসের ছোট্ট এক কফিশপে একদিন আমার ছবির একক প্রদর্শনী হবে’। না, সেই দাম পাননি ভিনসেন্ট। জীবদ্দশায় সম্মানও পাননি বিন্দুমাত্র। অথচ তার মৃত্যুর দাম আজ কোটি কোটি টাকা। বা হয়তো এই মূল্য এই রহস্যের।
এসডব্লিউ/এসএস/২২৪২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ