বিশেষ প্রতিবেদক : বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যকার সম্পর্কে টানাপোড়েন বড় ধরণের রদবদল নিয়ে আসতে পারে দেশের রাজনীতিতে। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা অস্বস্তিকর অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি এই সংগঠন ও তার নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করার পর হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের বিবাদ নতুন মাত্রা পেয়েছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের এই ইসলামপন্থী দল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর পরবর্তী বছরগুলোতে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের এক ধরণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সংগঠনটির প্রয়াত আমীর আহমদ শফী এবং তার ছেলে আনাস মাদানীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। কিন্তু আহমদ শফীর মৃত্যুর পর আনাস মাদানী ও তার সমর্থকদের সরিয়ে বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন করার পর থেকে বদলে যেতে থাকে সমস্ত সমীকরণ। নতুন কমিটির অনেকেই সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত। ফলে হেফাজত এবং সরকারের মধ্যে যে সহাবস্থান এবং সুসম্পর্ক ছিল, সেটার অবনতি সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সেটা যে এতো দ্রুত ঘটবে সেটা বোঝা যায়নি।
সহিংস আন্দোলনের দায় কার?
হেফাজতে ইসলামের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী কর্মসূচিকে ঘিরে অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ সংখ্যা ১৮ বলে দাবি হেফাজতে ইসলামের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারিতে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হেফাজতের কর্মীরা এসব এলাকায় ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নি-সংযোগ করে। যদিও বিক্ষোভে সরকারি দলের কর্মীদের হামলার কারণে বিক্ষোভ ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি জানিয়েছেন হেফাজত নেতাকর্মীরা।
তাদের মাদ্রাসা, তাদের বাড়িঘরগুলোতেও যদি আগুন লাগে তারা কী করবে? জনগণ কি বসে বসে এগুলো খালি সহ্য করবে?— প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব নাছির উদ্দীন মুনীর বলেন বাইতুল মোকাররমে আমাদের কর্মসূচি স্বাভাবিক-শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন এসে প্রথমে হামলা করে। মসজিদে ঢুকে মুসল্লীদের পেটানো হয়েছে। মূলত মসজিদে ঢুকে যেভাবে হামলা করা হয়েছে, সেটার কারণেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে সবখানে।
তিনি বলেন, যদি সরকার এবং দলীয় লোকেরা আমাদের বাধা না দিতেন তাহলে অপ্রীতিকর কোনও পারিস্থিতি তৈরি হতো না। তারা সবখানে বাধা দিয়েছে এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী গুলি চালিয়েছে। সুতরাং এর দায় তাদেরই নিতে হবে।
এর আগে ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনে দেখা গিয়েছিল হেফাজতে ইসলামকে। তবে সেসময়ের তুলনায় এবার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে ছিল সরকার। এবার দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাও সক্রিয় ছিলেন রাজপথে। তবে পরিস্থিতি’র অবনতির জন্য হেফাজত সরকার ও সরকারি দলকে দায়ী করলেও আওয়ামী লীগ বলছে ভিন্ন কথা।
দলটির যুগ্ম সাধারণ মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, পুলিশ তো সংঘাত করেনি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও হামলা করেনি। বাইতুল মোকাররমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হেফাজতের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ঘটেছে। পুলিশ অ্যাকশন নিয়েছে।
কিন্তু হাটহাজারিতো কিছু হয়নি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো কিছু হয়নি। কেন তারা সেখানে তাণ্ডব করেছে। তারা থানা লুট করতে গেছে। তাহলে পুলিশ কী করবে? পুলিশ তো আত্মরক্ষার জন্যেই কঠোর হয়েছে।
সম্পর্ক কি একদমই নেই?
যদিও রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন সরকার এবং হেফাজতে ইসলামের বর্তমান অবস্থান প্রসঙ্গে বলেন, জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে নতুন হেফাজত কমিটি দায়িত্ব নিয়েই তাদের একটা অবস্থান এবং শক্তির জানান দেয়ার চেষ্টা করছিল। তাদের প্রথম কর্মসূচি ছিল মুজিব ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান। তারা সরকারের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেছে।
এটা সরকারের জন্য অনেক অস্বস্তিকর ছিল। কারণ নতুন কমিটি নিয়ে সরকারের মধ্যে অবিশ্বাস আছে, যেহেতু সংগঠনের অনেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নেতা। আবার মোদি বিরোধী বিক্ষোভের সময় সরকার কঠোর অবস্থান নিয়ে হেফাজতকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। মাঠে কঠোর হলেও, নেতাদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর পদক্ষেপে যাচ্ছে না সরকার।
তিনি বলেন, সরকার এখনও তাদের সুযোগ দিচ্ছে, সরকার বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার। সুতরাং সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার মাত্রায় একটা হয়তো পরিবর্তন আসতে পারে।
এদিকে হেফাজত নেতা নাছির উদ্দীন মুনীর বলেন, সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে এরকমটা বলা যাবে না। আমরা অরাজনৈতিক সংগঠন। আমাদের ধর্মভিত্তিক কিছু দাবি দাওয়া থাকবে বা ইসলাম বিরোধী কিছু ঘটলে আমরা এর প্রতিবাদ করবো।
অন্যদিকে হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার নমনীয় আচরণ করছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সেটা নাকচ করে দিচ্ছেন। তার ভাষায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকার কিংবা দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সমঝোতায় বিশ্বাসী নয়।
তবে সম্পর্কের মাত্রায় পরিবর্তন হোক বা না হোক, একটা টানাপোড়েন যে তৈরি হয়েছে সেটা স্পষ্ট।
হেফাজতকে ইসলামের কলঙ্ক বললেন প্রধানমন্ত্রী
রবিবার (৪ এপ্রিল) জাতীয় সংসদে দেওয়া সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী মামুনুল হকের প্রসঙ্গে বলেন, এদের চরিত্র নিয়ে কিছু বলতে চাই না। গতকালই আপনারা দেখেছেন। ধর্ম ও পবিত্রতার কথা বলে অপবিত্র কাজ করে ধরা পড়ে এরা। সোনারগাঁয়ে একটি রিসোর্টে হেফাজতের যুগ্ম সম্পাদক ধরা পড়লো। তা ঢাকার জন্য নানা রকম চেষ্টা করেছে তারা। পার্লারে কাজ করা এক মহিলাকে বউ হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার নিজের বউয়ের কাছে বলে যে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এটা বলে ফেলেছি।
যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, এ রকম মিথ্যা কথা তারা বলতে পারে? অসত্য কথা বলতে পারে? যারা মিথ্যা বলতে পারে, তারা কী ধর্ম পালন করবে? মানুষকে কী ধর্ম শেখাবে?
এরা ইসলাম ধর্মের নামে কলঙ্ক। ইসলাম ধর্মকে তারা ছোট করছে। কিছু লোকের জন্য আজকে এই ধর্মটায় জঙ্গির নাম, সন্ত্রাসের নাম। আর এখন যে চরিত্র দেখালো, সেখানে দুশ্চরিত্রের নাম। সব নাম জুড়ে দিচ্ছে এরা।
হেফাজতিরা ইসলামকে কলুষিত করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। যে ইসলাম সব থেকে সহনশীলতা শিখিয়েছে। শান্তির কথা বলেছে। সাধারণ মানুষের কথা বলেছে। মানুষের উন্নয়নের কথা বলেছে। সেই পবিত্র ধর্মকে এরা কলুষিত করে দিচ্ছে। এরা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। এই বিনোদনের এত অর্থ কোত্থেকে আসে। এটার বিচার করবে দেশবাসী। আইন আইনের গতিতে চলবে।
হেফাজতকে কোণঠাসা করার চেষ্টা!
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ফেসবুক লাইভ করে রোববার দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে তার সম্পর্কে না জেনে ‘অসত্য’ মন্তব্য করেছেন। এছাড়া রিসোর্টে নিজের সাথে থাকা নারীকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে বলেছেন, সে শরীয়তসম্মত উপায়ে, হালাল উপায়ে আমার বৈধ স্ত্রী। যারা ‘মিথ্যা’ তথ্য দিচ্ছে তাদের উপর আল্লাহর গজব পড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে, এর আগে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহকারী প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘বিভ্রান্তিমূলক’ তথ্য পেয়ে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন।
মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত না হয়ে, মিথ্যা সংবাদ শুনে এবং সুপার এডিটিং করে যে সমস্ত ভিডিও গতকাল প্রচার হয়েছে, সে কথা শুনে তিনি জাতীয় সংসদে যে কথা বলেছেন, তাতে আমরা বিব্রত এবং হতভম্ব।
বিষয়টি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বসে প্রতিবাদ কর্মসূচী নির্ধারণ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির বলেছেন, সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বকে হেয়-প্রতিপন্ন করে সংগঠনটিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে।
সমস্যার মূল কোথায়?
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ কিছু প্রশ্নই বাতাসে ঘুরছে। বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে গত দু’সপ্তাহের ঘটনায় সরকারের সাথে হেফাজতে ইসলামের বিবাদ যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে হেফাজতে ইসলামের সাথে আওয়ামী লীগের একটা প্রচ্ছন্ন সমঝোতা আছে বলে এতদিন বলা হতো, সেখানে এ সমস্যার শুরু কোন ঘটনা থেকে? এই সমস্যার মূল কোথায়? সমস্যাটা কি পুরো সংগঠনটির সাথেই, নাকি এর বর্তমান নেতৃত্বের সাথে?
দৃশ্যত বিবাদের শুরু হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের নেয়া কর্মসূচিকে ঘিরে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা আসাকে কেন্দ্র করে।
একে কেন্দ্র করে হেফাজতের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ব্যাপক সহিংস রূপ ধারণ করে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ইসলামপন্থী দলটির অন্যতম শীর্ষ নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে এক অস্বস্তিকর অভিযোগ ওঠে।
“আরও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার সরকারের যে স্বপ্ন, মোদিকে এনে তা পাকাপোক্ত করার যে অশুভ উদ্দেশ্য, এর বিরুদ্ধে যেহেতু হেফাজত অবস্থান নিয়েছে সেজন্য হেফাজতে উপরে সরকার চড়াও হয়েছে।”
এদিকে, মোদির সফরকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকদিন ধরে চলা সহিংস বিক্ষোভের তীব্র সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় সংসদ টিভির পর্দায় ২৬, ২৭ এবং ২৮শে মার্চ দেশের বিভিন্ন জেলায় হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিকাণ্ডের ছবি প্রদর্শন করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, ভারত নিয়ে তাদের আপত্তি, তারা শিক্ষা গ্রহণের জন্য দেওবন্দে যায় না? মোদি বিরোধী বিক্ষোভে হেফাজতের তাণ্ডবের পেছনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জড়িত বলে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আগুন নিয়ে খেলছে তারা। এক ঘরে আগুন লাগলে তো সেই আগুন অন্য ঘরেও চলে যেতে পারে, সেটা কি তাদের হিসাবে নেই? আজকে রেল স্টেশন থেকে শুরু করে ভূমি অফিস থেকে ডিসি অফিস থেকে শুরু করে সবখানে যে আগুন দিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের মাদ্রাসা, তাদের বাড়িঘরগুলোতেও যদি আগুন লাগে তারা কী করবে? জনগণ কি বসে বসে এগুলো খালি সহ্য করবে?
সরকার ও হেফাজতের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
সোনারগাঁও এলাকায় একটি রিসোর্টে শনিবার বিকেলে মামুনুল হককে ঘেরাও করে রাখে স্থানীয় কিছু লোক এবং ক্ষমতাসীন দল-সম্পৃক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা। তাদের অভিযোগ, মামুনুল হক একজন নারীকে নিয়ে রিসোর্টে ঘুরতে গিয়েছেন। অন্যদিকে মামুনুল হক বলেন, মহিলাটি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর হেফাজতে ইসলামের সমর্থক এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা পাল্টা হামলা চালিয়ে সেখান থেকে মামুনুল হককে নিয়ে যায়।
এরপর থেকেই ক্রমাগত হেফাজতে ইসলামের আদর্শ এবং তার নেতৃত্ব নিয়ে সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে আসছে তীব্র সমালোচনা। এতে হেফাজতে ইসলামের প্রতি সরকারের কঠোর অবস্থান অনেকটাই পরিষ্কার।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির বলছেন, সরকার তাদের শীর্ষ নেতৃত্বকে হেয়-প্রতিপন্ন করে সংগঠনটিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলছেন, সরকার তার দলীয় গুণ্ডাদের হেফাজতের নেতাদের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে। হেফাজত এবং ইসলামের পক্ষে যারা কথা বলে, তাদেরকে স্তব্ধ করার জন্য সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
মামুনুল হক যেহেতু সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাই ওনাকে হেনস্তা করে জাতির সামনে মূল্যহীন করার জন্য, হেফাজতকে বস্তাবন্দী করার জন্য এটা তাদের ষড়যন্ত্র বলে আমি মনে করি।
নাছির উদ্দিন মুনির বলছেন, আরও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার সরকারের যে স্বপ্ন, মোদিকে এনে তা পাকাপোক্ত করার যে অশুভ উদ্দেশ্য, এর বিরুদ্ধে যেহেতু হেফাজত অবস্থান নিয়েছে সেজন্য হেফাজতে উপরে সরকার চড়াও হয়েছে।
কিন্তু হেফাজত এর আগে আরো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। সরকারের এই চাপের কাছে সংগঠনটি নতি স্বীকার করবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সমস্যা কি আদর্শগত নাকি নতুন নেতৃত্ব?
গত কয়েক বছর ধরেই আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলামের মধ্যে সুসম্পর্ক দেখা গেছে। সংগঠনটির প্রয়াত আমীর আহমদ শফীর সাথে একই মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এরপর প্রধানমন্ত্রীকে ইসলামপন্থী বেশ কটি দলের পক্ষ থেকে ‘কওমি জননী’ বলে উপাধি দেয়া, পাঠ্য পুস্তকে পরিবর্তন, ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া সহ হেফাজতে ইসলামের নানা ধরনের দাবি মেনে নেয়া, সব মিলিয়ে মনে করা হচ্ছিল যে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলির মধ্যে হেফাজতে ইসলামের সাথেই সরকারের সবচাইতে বেশি সমঝোতার সম্পর্ক।
তবে গত বছর আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে এসেছে পরিবর্তন। এর পর থেকেই হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সরাসরি সরকারের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে। তার সরাসরি বহিঃপ্রকাশ ছিল নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা আর সহিংস বিক্ষোভে।
তার আগে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম। ভাস্কর্য বিরোধিতা সরকারের সাথে তাদের বোঝাপড়ায় ‘ফাটলের ইঙ্গিত’ বলে মনে করা হচ্ছিল। এখন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে হেফাজত সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আক্রমণের জন্য দায়ী করছে। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে সরকার।
“হেফাজতে ইসলামকে ঘিরে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবার সম্ভাবনা আছে, যদি তারা সেটা চায়।”
এখন যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে, তা হল সরকারের সাথে হেফাজতে ইসলামের এই বিবাদ কি আদর্শ নিয়ে, নাকি এর বর্তমান নেতৃত্বের সাথে?
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখা, সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়েছে। হয়ত যারা আগে নেতৃত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও একটা সহনশীলতার মনোভাব ছিল, জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ছিল না বিধায় সরকারের পক্ষে তাদের সহজে নিষ্ক্রিয় রাখা সম্ভব হয়েছিল।
হেফাজতে ইসলামের এখনকার নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এখন যারা হেফাজতে আছে, বরাবরই এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ছিল, বেশিরভাগই স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে সরাসরি নিজেরা অংশগ্রহণ করেছে অথবা এখন তাদের সন্তান যারা তারা দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তার মতে সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে একদম জামাতে ইসলামের মতো উগ্রবাদিতা দেখা যাচ্ছে। এদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় এনে দমন করা ছাড়া সরকারের আর কোন বিকল্প নেই।
পরবর্তী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে চাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম
রাজনীতির বিশ্লেষক তারেক শামসুর রহমান এর পিছনে কয়েক ধরনের রাজনীতি কাজ করছে বলে মনে করছেন। তিনি মনে করেন হেফাজতে ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান তৈরি করতে চায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী শক্তির নিস্ক্রিয়তা রয়েছে। যারা সংসদে বিরোধী দলে রয়েছে, যারা মাঠের বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপি, তাদের কারও কাছ থেকে কোনও সক্রিয় ভূমিকা আমরা দেখছি না। সরকার বিরোধী নিষ্ক্রিয়তা একটি শূন্যস্থান তৈরি করেছে।
হেফাজতের যেভাবে উত্থান হয়েছে দেখছি, তারা এখন প্রমাণ করতে চাইছে যে তারাই পরবর্তী রাজনৈতিক শক্তি। হেফাজতে ইসলাম সরকারের মিত্র হিসেবে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এখন সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে।
যদিও হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়ে থাকে যে তারা কোন রাজনৈতিক দল নয়।
কী ঘটতে পারে সামনে?
সূত্র মতে, হেফাজতে ইসলাম আগামী দিনগুলোতেও বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান এবং শক্তি জানান দেবে বলে জানা গেছে। এমনকি মোদি বিরোধী বিক্ষোভে হেফাজত কর্মীদের প্রাণহানির প্রতিবাদে আরও কর্মসূচি দেয়ার পক্ষেও জোরালো মতামত আছে সংগঠনটিতে। এদিকে তেমনটা হলে সরকারও কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়ে রেখেছে। তাই পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে।
রাজনীতির বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক বড় ধরনের অবনতি ঘটলে সেটা বাংলাদেশের রাজনীতির সমীকরণই ওলট-পালট করে দেবে। হেফাজতের মধ্যে একটা রাজনীতির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কারণ সংগঠনটির নেতাদের অনেকেই সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের অন্তর্গত। সংগঠনটিকে ঘিরে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবার সম্ভাবনা আছে, যদি তারা সেটা চায়।
ফলে সরকারের চোখ কিন্তু এখন শুধু আর হেফাজতের বাউন্ডারির মধ্যে নেই। এখানে মূল জায়গায় হেফাজত থাকলেও অনেক কিছুই নির্ভর করছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কী করছে তার উপর। নিকট ভবিষ্যতেই হয়তো জানা যাবে, হেফাজতে ইসলাম বিভক্ত থাকবে নাকি ইউনাইটেড ফোর্স হিসেবে আবির্ভূত হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ