সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘা এখনো শুকোয়নি। হিন্দু ধর্মের অনুসারী সংখ্যালঘুরা এখনো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শাল্লারে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণের ঘা শুকানোর আগেই মাগুরায় আরেক আতঙ্ক দেখা দেয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হিন্দু থেকে মুসলিম হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চরগোয়ালদহ ও মালাইনগর গ্রামে ৫০-এর অধিক হিন্দু বাড়িতে কারা যেন চিঠি পাঠায়। এসবের রেশ কাটতে না কাটতেই দেশজুড়ে শুরু হয় হেফাজত ইসলামের মোদিবিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচি। এতে সারাদেশে হেফাজত কর্মীরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়, আগুনে পুড়িয়ে দেয় বিভিন্ন স্থাপনাসহ ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো। এসবের মাঝে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আতঙ্কে দিন কাটালে এরইমধ্যে মাগুরায় আরেক নৃশংসতার খবর পাওয়া গেছে। মাগুরার মহম্মদপুরে চারশ’ বছরের পুরাতন পড়ুয়ারকুল অষ্টগ্রাম মহা শ্মশান ও রাধাগোবিন্দ আশ্রমের তিনটি ঘরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আগুনে তিনটি ঘরের অংশিক অংশ, রথ ও প্রতিমা পুড়ে গেছে। এতে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
আজ সোমবার(২৯ মার্চ) সকালের দিকে প্রশাসনের লোকজন ও জেলার হিন্দু নেতারা পড়ুয়ারকুল গ্রামের ওই মন্দির পরিদর্শন করেন।
মহম্মদপুরের ইউএনও রামানন্দ পাল, মহম্মদপুর থানার ওসি তারকনাথ বিশ্বাস, স্থানীয় বাবুখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মীর সাজ্জাদ আলী ও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বলে জানিয়েছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) হরেকৃষ্ণ অধিকারী।
জানা যায়, ভোরে মন্দিরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী গুরুদাস কাজে গিয়ে মন্দিরে আগুন দেখতে পান। এ সময় মন্দির কমিটির সচিব লক্ষ্মণ গোলদারকে খরব দেন তিনি। সচিব ফায়ার সার্ভিস ও প্রশাসনকে জানালে মহম্মদপুর থেকে দমকল বাহিনী যাওয়ার আগেই আগুন নিভে যায়।
আগুনে পড়ুয়ারকুল অষ্টগ্রাম রাধাগোবিন্দ মন্দিরের প্রার্থনাগৃহ ও দুটি ঘর আগুনে আংশিক পুড়েছে। এছাড়া রথটি পুড়ে গেছে; তবে বিগ্রহ অক্ষত আছে বলে জানা গেছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হরেকৃষ্ণ অধিকারী ঘটনাস্থল থেকে বলেন, “পড়ুয়ারকুল অষ্টগ্রাম রাধাগোবিন্দ মন্দিরের প্রার্থনা গৃহ ও দুটি ঘর আগুনে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রথটি পুড়ে গেছে। তবে বিগ্রহ অক্ষত আছে। তদন্ত না করে বলা যাচ্ছে না এটা দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা।”
তবে মহম্মদপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও হিন্দু-বৈদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রিয় কমিটির সংগঠনিক সম্পাদক স্বপ্না রানী ঘটনাটিকে নাশকতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির অপকৌশল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব কুন্ডু জানান, স্থানীয়রা তাকে একটি মন্দিরসহ তিন ঘরে আগুন দেওয়া ও রথ এবং পতিমায় আগুন দেওয়া বিষয়ে জানিয়েছে। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিষয়টি নাশকতা বলে দাবি করে তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পুলিশ সুপার জহিরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে কোনো্ প্রকার নাশকতার প্রমাণ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জেলা মাগুরাতে কোনো অসম্প্রদায়িক শক্তিকে বিন্ধু মাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।
কদিন আগেও মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চরগোয়ালদহ ও মালাইনগর গ্রামে ৫০-এর অধিক হিন্দু বাড়িতে কারা যেন চিঠি পাঠায়। রাতের বেলায় মাথায় হেলমেট পরে পরিচয় গোপন রেখে একই ধরনের চিঠির ঘটনায় ওই এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা ও আতঙ্ক দেখা দেয়।
জানা যায়, গত ১৯ মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর পাঞ্জাবি পাজামা পরিহিত কয়েকজন ব্যক্তি হেলমেট পরা অবস্থায় বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাড়ির কর্তাদের নামে খামে ভরা ওই চিঠিগুলি বাড়ির সদস্যদের হাতে দিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেলে এলাকা থেকে সরে পড়ে। ওই গ্রামের ৫০টির বেশি বাড়িতে পরপর চিঠিগুলি বিতরণ করা হয়। চিঠিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওইসকল ব্যক্তিকে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত বিভিন্ন কথা লেখা ছিল। চিঠির সবশেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয় তাদের। এ ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে হুমকি দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ছয় হিন্দু পরিবারের বসতঘর। গত শনিবার গভীর রাতে উপজেলার মায়ানী ইউনিয়নের পূর্ব মায়ানী মনুভূঁঞাপাড়ায় মৃত অর্জুন শীলের বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাড়ির মৃত অর্জুন শীল, সহদেব শীল, জয়দেব শীল, বাসুদেব শীল, শেফালী শীল ও নীলিমা শীলের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। খবর পেয়ে ভারপ্রাপ্ত ইউএনও সুবল চাকমা, থানার ওসি মজিবুর রহমানসহ হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট ও পূজা উদযাপন পরিষদ নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নুপুর ধর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ‘এখানকার ৪টি ঘরে বিদ্যুত লাইন ছিল না। আর সবকটি ঘরে একযোগে আগুন লাগে। এটি কোন সাধারণ অগ্নিকান্ডের ঘটনা নয়। তবে কোন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও ঘটনাটি ঘটায়নি। প্রশাসনের কাছে বিষয়টি তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। শাল্লারের ঘটনার রেশ এখনো যায়নি, এরই মধ্যে মাগুরায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বানের পর মাগুরায় মন্দিরে শ্মশানে আগুন দেওয়াকে স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। সাম্প্রদায়িক কিছু ব্যক্তি দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরী করতে পারে। এ ব্যাপারের প্রশাসনসহ সরকারকে সচেতন থাকতে হবে।
তারা বলেন, ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের দলগুলো ইসলামপন্থীদের, বিশেষ করে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে সমাজে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তাদের শক্তির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে পড়েছে। রাজনীতির আলোচনার সূচি অংশত তারাই নির্ধারণ করছে। আশু এ অবস্থার অবসানের সম্ভাবনা নেই; উপরন্তু তা আরও বিস্তৃত হবে বলেই অনুমান করা যায়।
তারা বলেন, ‘বাংলাদেশে বরাবরই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে৷ আর এখন মূলত রাজনৈতিক অস্থির অবস্থা এবং নীতিহীন রাজনীতি এর জন্য দায়ী৷ বাংলাদেশ যতই তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছে, ততই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বাড়ছে৷
তারা মনে করেন, শাসক দলের পরিচিতি বা সমর্থন ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ খুবই কম৷ নেই বললেই চলে৷ তাই এই ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা সব সময়ই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকতে চায়৷ যেহেতু এই মূহূর্তে বাংলাদেশে শাসক দলের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির তেমন কোনো অবস্থান নেই বললেই চলে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সরকারি দল বা সরকারি দলের মধ্যে ঢুকে দুষ্কৃতকারীরা বা ওই দলের নেতা-কর্মীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতেই পারে৷ এটাকে নীতিহীন রাজনীতির ফল বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৯
আপনার মতামত জানানঃ