ভারতের উত্তরাখণ্ডকে বলা হয় দেবতার আবাস। এখানে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ সহ প্রচুর প্রসিদ্ধ হিন্দু দেবস্থান আছে। হরিদ্বার, ঋষিকেশকে তো মন্দিরনগরী বলা হয়। সেখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে এতোদিন কোনো ধরনের নির্দেশিকা দেখা যায়নি। সেই উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনে অন্তত ১৫০টি মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশে ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছে হিন্দু যুব বাহিনী নামে একটি উগ্র ডানপন্থী সংগঠন। আজ সোমবার (২২ মার্চ) স্থানীয় সময় সকালে দেরাদুনের চাকার্তা রোড, শুদ্ধওয়ালা ও প্রেম নগর এলাকার মন্দিরগুলোতে এ নির্দেশিকা ঝোলানো হয়। খবর ডয়েচে ভেলে।
সংগঠনটি বলছে, আগামী দিনে রাজ্যের সব মন্দিরেই এমন ব্যানার লাগাবে তারা। সেখানে স্পষ্টভাবে সনাতন ধর্মের মানুষ ছাড়া অন্য কারও মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। কারণ মন্দির সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজনের শ্রদ্ধার স্থান। তাই এবার থেকে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মের মানুষ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবে।”
মনে করা হচ্ছে কিছুদিন আগে মুসলিম যুবকের হিন্দু মন্দিরে গিয়ে পানি খাওয়ার জন্য এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে হিন্দু যুবা বাহিনী। আসলে কিছুদিন আগে দাসনার একটি মন্দিরে মুসলিম প্রবেশ নিষেধ বোর্ডে লেখা থাকলেও সেখানে এক মুসলিম যুবক মন্দিরের কল থেকে পানি পান করে। পরে মন্দিরের পুরোহিতের নির্দেশে ওই যুবককে নিগ্রহ করা হয়। ঘটনার জেরে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তারপর আবার উত্তরাখণ্ডের একাধিক মন্দিরে অ-হিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ নির্দেশিকা সমালোচনার আগুনে ঘিয়ের কাজ করছে।
হিন্দু যুব বাহিনীর রাজ্য সম্পাদক জিতু রান্ধওয়া জানান, দাসনার মন্দিরের পুরোহিত জাতি নরসিংহানন্দর সমর্থনেই ওই পোস্টার। আগামী দিনে উত্তরাখণ্ডের সমস্ত মন্দিরেই এমন ব্যানার লাগাবে তারা। যেখানে স্পষ্ট করে বলা থাকবে সনাতন ধর্মের মানুষ ছাড়া আর কেউ মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবে না।
মন্দিরে মুসলিম যুবককে নিগ্রহের ঘটনায় পুরোহিতের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন এক বিএসপি বিধায়ক ধৌলানা আসলাম চৌধুরি। দাসনাদেবীর মন্দিরকে তার পূর্বপুরুষের সম্পত্তি বলে দাবি করে আসলাম বলেছিলেন, তিনি দাসনার মন্দির থেকে অবিলম্বে ওই পোস্টার সরানোর ব্যবস্থা করবেন। যাতে অ-হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশে কোনও বাধা না থাকে।
জিতু জানিয়েছেন, আসলামের ওই হুমকির প্রতিবাদে এবং দাসানার মন্দিরের পুরোহিতের সমর্থনে উত্তরাখণ্ডের সমস্ত মন্দিরের বাইরে এই নির্দেশিকার নথ ঝোলাবেন তারা।
জিতু বলেন, ‘‘মন্দির সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজনের শ্রদ্ধার স্থান। তাই শুধু সনাতন ধর্মের মানুষজনেরই মন্দিরে প্রবেশের অধিকার থাকা উচিত।’’
দেবভূমি হিসেবে পরিচিত উত্তরাখণ্ডে অজস্র মন্দির রয়েছে। হিন্দুধর্মের চার ধাম কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীও এই উত্তরাখণ্ডেই। দেবভূমিতে প্রত্যেক বছর অনেক মানুষের ঢল নামে। বিদেশ থেকেও মানুষ আসেন কেদারনাথ, বদ্রিনাথ দর্শনে। দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষ আসেন এই তীর্থ দর্শনে। তাই মন্দির কর্তৃপক্ষকে দেশ-বিদেশের অন্যান্য ধর্মালম্বীদের প্রবেশাধিকারের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি তারা।
২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু হয়েছে। তখন থেকেই হিন্দু উগ্রবাদী জনতা গো-হত্যার সন্দেহে মুসলমানদের উপর হামলা ও তাদের পিটিয়ে হত্যা করছে। গরুর গোশত খাওয়া ও রাখা নিয়েও হিংসার বলি হতে হচ্ছে।
হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানদের উপর হানাদার হামলার আকারে প্রায়শই মুসলমানদের উপর সহিংসতা সংঘটিত হয়। এই আক্রমণগুলোকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এক অংশ হিসাবে দেখা যায় এবং বিংশ শতাব্দীতে পুরো বিশ্ব জুড়ে ইসলামফোবিয়ার উত্থানের সাথেও যুক্ত রয়েছে।
আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা মতে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ইন্দোনেশিয়াকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশে পরিণত হবে ভারত। দেশের বৃহত্তম ধর্মীয়-সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়গুলি প্রায়শই সন্ত্রাসী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা সহিংস আক্রমণ ও হামলার শিকার হয়েছে। অতীতে, এই আক্রমণগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে বিবেচিত ছিল এবং হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। তবে, বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পরে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে সাথে আক্রমণগুলো আরও নিয়মতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র-অনুমোদিত কার্যক্রমের আকার নিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হওয়ার পর ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাবলীতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রায় ১০,০০০ মুসলিম নিহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতির কোনও উন্নতিই নেই। আর যেভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তৈরি করা হচ্ছে, তার পরিণতি যে দেশটিকে কোথায় নিয়ে যাবে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সবগুলো ঘটনাই তো শকিং, এগুলো থেকে তো বাছ বিচার করা যায় না।
তারা মনে করেন, ভারতের ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক এসব ঘটনা সরাসরি প্রভাব ফেলে বাংলাদেশের ওপর। ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষের বলি হলে বাংলাদেশেও তাই হয়। পরস্পর বিরোধী দুটি ধর্মের মানুষ দুটি দেশে সংখ্যালঘু হওয়ায় ধর্মীয় বিদ্বেষে সৃষ্ট অরাজকতা দুই দেশেই প্রতিযোগিতামূলকভাবে হয়। এসব দূর না হলে দেশ দুটিতে ধর্মীয় ইস্যুতে ভয়াবহ কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৯৪৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতা করুন।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ