মিয়ানমারে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভে জান্তা সরকার পরিচালিত বিক্ষোভকারী দমন অব্যাহত রয়েছে। এমন দমননীতিতে ইতিমধ্যে অনেক বিক্ষোভকারীরই প্রাণ গিয়েছে। তবে গতকাল রোববার(১৪ মার্চ) জান্তা সরকারের দমনের কবলে পড়ে রেকর্ডসংখ্যক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। এদিন দেশটিতে বিক্ষোভ করার সময় অন্তত ৩৯ জন নিহত হয়েছে। গতকাল দেশজুড়ে কমপক্ষে ৩৯ জন নিহত হওয়ার পর আজ সোমবার(১৫ মার্চ) বড় ধরনের সেনাবিরোধী সমাবেশের পরিকল্পনা করেছেন মিয়ানমারের আন্দোলনকারীরা।বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও বিবিসি এমন খবর দিয়েছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চি’র নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে চলমান আন্দোলনে রোববারই ছিল সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন।
বিবিসি জানায়, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গতকাল রোববার সকাল থেকেই ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় জান্তা সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করার চেষ্টা করলে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলি চালায় দাঙ্গা পুলিশ। ছোঁড়া হয় টিয়ার শেল। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায় বেশ কয়েকজনকে। মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা ইয়াঙ্গুন। চলে ধরপাকড়। আতঙ্কিত হয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন সাধারণ মানুষ। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে শহরের নিকটবর্তী এলাকাগুলোতেও।
এদিন পুলিশির বাধার মুখে সহিংস বিক্ষোভ হয় কাচিন প্রদেশের কয়েকটি শহরেও। সেখানেও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে, সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। এতে বেশ কয়েকজনের হতাহতের খবর জানায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি।
সারা দিন গুলির শব্দ শোনা গেছে এবং রাস্তায় সামরিক ট্রাকের টহল ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এক পুলিশ সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, পুলিশ ভারী অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। পরে মুছে ফেলা টিকটক পোস্টে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, কোনও দয়া দেখাবো না।
শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত হ্লায়াইং থারইয়ায় চীনের বেশ কয়েকটি কারখানায় হামলা চালিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তারা দুইটি কারখানায় অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়।
বর্মি আন্দোলনকারীরা বলছেন, দেশটির জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বেইজিং। ফলে এরইমধ্যে দেশটিতে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক উঠতে শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় রবিবার একাধিক চীনা ফ্যাক্টরিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর সামরিক সরকার চীনা কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকা এলাকাটিতে মার্শাল ল জারি করেছে।
বেইজিং বলছে, মানুষজন লোহার রড, কুড়াল ও পেট্রোল নিয়ে হামলা চালিয়েছে ১০টি কারখানায়। এ সময় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক আহত হয়েছে। এছাড়া চীনা একটি রেস্তোরাঁতেও হামলা হয়েছে।
বার্মায় নিযুক্ত চীনা দূতাবাসের এক বিবৃতিতে সব ধরনের নৃশংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং চীনা নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই বিবৃতির পরই চীনা কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকা এলাকায় সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেয় জান্তা সরকার।
চীনকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সমর্থক হিসেবে ভাবা হয়। সামরিক অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচিকে আটকের ঘটনাকে ‘মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল’ বলে উল্লেখ করেছিল চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিনহুয়া।
এর আগে গত ৩ মার্চ একদিনে ১৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন। এতদিন জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে একদিনে ওটাই ছিল সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা। সব মিলিয়ে রোববার পর্যন্ত জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে ১২৬ জন প্রাণ হারালেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলে নেয় সামরিক বাহিনী। ২০২০ সালের নভেম্বরে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। কিন্তু ভোটের ফলাফল সামনে আসার পর থেকেই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আনে সেনাবাহিনী।
এই অভিযোগ এনেই বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং সু চিসহ তার দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে আটক করা হয়। এরপর থেকেই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে মিয়ানমার। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চিকিৎসকসহ দেশটির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এদিকে বিক্ষোভ থামাতে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত ঘোষণা দিয়েছে দেশটির ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সঘোষিত বেসামরিক সরকার। শনিবার অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রকাশিত এক ফেসবুক ভিডিওতে ছায়া সরকারের প্রধান এনএলডির অন্যতম শীর্ষ নেতা মান উইন খাইং থান বলেন, বর্তমান জান্তা সরকারবিরোধী আন্দোলন ভবিষ্যতে বিপ্লবে রূপ নেবে। আগামী দিনে অভ্যুত্থানের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার অঙ্গীকারও করেন তিনি।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর লুকিয়ে থাকা আইনপ্রণেতারা ঘোষণা দিয়েছেন যে, সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চলবে। তারা নিজেদেরকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী বলছে, এই আইনপ্রণেতাদের সহায়তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
এনএলডির যে আইনপ্রণেতারা গ্রেফতার এড়াতে পেরেছেন, তারা পালিয়ে নতুন একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন, যার নাম কমিটি ফর রিপ্রেজেন্টিং পাইডুংসু হলত্তু (সিআরপিএইচ)। এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছেন মাহন উইন খিয়াং থান। তিনি বলেছেন, ”এটা জাতির জন্য সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্ত তবে খুব তাড়াতাড়ি আলোর দেখা পাওয়া যাবে।”
মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করছে সিআরপিএইচ। একটি ফেসবুক বার্তায় মাহন উইন খিয়াং থান বলেছেন, এটা এমন একটা সময় যখন অন্ধকারে বিরুদ্ধে আমাদের নাগরিকদের লড়াই করার ক্ষমতার পরীক্ষা হচ্ছে। অতীতে আমাদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও এখন অবশ্যই আমাদের হাতে হাত ধরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ