চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের আনাগোনা ঠেকানো যাচ্ছে না। কিছু অস্ত্রবহনকারীও ধরা পড়ছে মাঝে মধ্যে। তবে অবৈধ অস্ত্রের কারবারিরা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সিন্ডিকেটের মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় অক্ষত থেকে যাচ্ছে তাদের নেটওয়ার্ক। সম্প্রতি নির্বাচনী সংঘাত সহিংসতায়ও প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে গোলাগুলিতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আগামী ১১ এপ্রিল জেলার ২৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সহসা বিশেষ অভিযান না হলে গ্রামেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৪ হাজার ২৭৫টি। এর মধ্যে মহানগরে ২ হাজার ৪৭৭টি ও উপজেলায় অবৈধ অস্ত্র আছে ১ হাজার ৭৯৮টি। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার আর অপরাধীদের গ্রেফতারে নেই বিশেষ অভিযান। সম্প্রতি নগরী এবং জেলায় সংগঠিত বেশ কয়েকটি সহিংসতায় প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে যারা মাঠে নেমেছিলো তারাও অধরা। এতে অস্ত্রধারীদের দাপট কমছে না। ফলে জনমনে উদ্বেগ-শঙ্কা বিরাজ করছে। বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা। তবে র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ অভিযান না হলেও নিয়মিত অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে, অপরাধীরাও ধরা পড়ছে। কোন ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও বিভিন্ন উপজেলায় পৌরসভা নির্বাচনেও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে নজিরবিহীন। এর মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় চসিক নির্বাচন ঘিরে ৩ জন ও পটিয়া পৌরসভা নির্বাচনে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাই নিহত হয়। চন্দনাইশেও পৌরসভা নির্বাচনে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এছাড়া নির্বাচনী সহিংসতায় বিভিন্ন স্থানে অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার হয়। নির্বাচনের আগের রাতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ফাঁকা গুলিবর্ষণের মাধ্যমে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা হয়। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে ওই দিন একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।
নির্বাচনের কদিন আগে ১২ জানুয়ারি নগরীর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের মগপুকুর পাড় এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আজগর আলী ওরফে বাবুল নামের এক মহল্লা সরদার গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এখনো উদ্ধার হয়নি এ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর শাহাদাত হোসেন বলেন, মামলা তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত এ মামলায় ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। এছাড়া নির্বাচনের আগের রাতেও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য নগরীর চান্দগাঁও, বাকলিয়া, বায়েজিদ বোস্তামী, পাহাড়তলীসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ফাঁকা গুলি ছোড়াসহ একাধিক ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছে অবৈধ অস্ত্র।
এদিকে ৭ বছরেও উদ্ধার হয়নি সিআরবির সাত রাস্তার মাথা এলাকায় রেলওয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাবল মার্ডারে ব্যবহৃত অস্ত্র। চট্টগ্রামে গত দুই বছরে জেলা ও নগরীতে অসংখ্য লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অধিকাংশ ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। বর্তমানে একাধিক কিশোর অপরাধী গ্রুপের হাতেও শোভা পাচ্ছে অবৈধ অস্ত্র।
সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, বৈধ অস্ত্রের যাতে অবৈধ ব্যবহার না হয় সেদিকে নজর রাখছে প্রশাসন। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।
চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্রেরও অপব্যবহার হচ্ছে। লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতায় ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ বিভিন্ন পর্যায়ে টাকা খরচ করে কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে অস্ত্রের লাইসেন্স পাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৈধ লাইসেন্সধারীদের মধ্যে অনেকে নিজের অস্ত্র পেশাদার অপরাধীদের কাছে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। কিশোর গ্যাং নামধারী উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন তথাকথিত রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি সবই হচ্ছে। চট্টগ্রামে এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তবে বৈধ অস্ত্র হওয়ার কারণে তাদের মালিকদের সহজে বাগে আনা যাচ্ছে না বলে দাবি করছে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি এখন আর ঐ পর্যায়ে নেই। কারণ চট্টগ্রামে যত অপরাধ হয় সেখানে বৈধ-অবৈধ সব রকমের অস্ত্রই ব্যবহার হয়। এত অস্ত্রের আমদানি কোথা থেকে হয়, সেটা আমাদেরও (পুলিশ বিভাগের) মনে প্রশ্ন আসে। অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের আগে আবেদনকারীর বিষয়ে ভালোমতো আরও অনুসন্ধান করার প্রয়োজন রয়েছে বলে ঐ পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবৈধ অস্ত্র থাকলে এর অবৈধ ব্যবহার হবেই। নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। মানুষ মারা গেছে। ভোটকেন্দ্রে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। ভোটের দিন অস্ত্র নিয়ে গোলযোগ সৃষ্টির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অথচ পুলিশ এখনো সেসব অস্ত্র উদ্ধার করছে না। নির্বাচন শেষ হলেও অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়ায় আতঙ্ক কাটছে না। কেননা অবৈধ অস্ত্রগুলো খুনাখুনি, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ জীবন এবং সম্পদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবেই। আশা করব প্রশাসন দ্রুত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ