ডিসেম্বরের শেষভাগে ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলের ভেতরে যখন ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভা বসে, তখন বাইরে শহরের স্বাভাবিক চেহারা আর ভেতরের কথাবার্তার বাস্তবতার মধ্যে তীব্র এক বৈপরীত্য তৈরি হয়। চকচকে আলো, পরিপাটি সাজ, নির্দিষ্ট সময়সূচির ভেতর বক্তৃতা—সবকিছুর মাঝেও আলোচনার কেন্দ্রে ছিল আগুন, ভাঙচুর, হামলা আর ভয়। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলার পর এই সভা শুধু গণমাধ্যমের সংহতির জায়গা ছিল না; এটি ছিল রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির গভীর এক সংকটকে নাম ধরে ডাকার চেষ্টা।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বলেই থামেননি জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তাঁর বক্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল সরাসরি অভিযোগ—সরকারের ভেতরের একটি অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এই হামলায়। বাংলাদেশে যেখানে সহিংসতার দায় সাধারণত ‘দুষ্কৃতকারী’ বা ‘অজ্ঞাত জনতা’র ঘাড়ে চাপানো হয়, সেখানে ক্ষমতার ভেতরের যোগসূত্রের কথা প্রকাশ্যে বলা রাজনৈতিকভাবে বড় ঝুঁকির বিষয়। নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য আসলে সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নটাকেই সামনে আনে, যেটা রাষ্ট্র বারবার এড়িয়ে যেতে চায়—এই মবগুলো কি সত্যিই স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি কারও প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা?
তিনি বলেন, হামলাকারীরা তাঁদের স্লোগান ব্যবহার করেছে, সেই স্লোগানের পক্ষে সমাজে আগেই একধরনের সম্মতি তৈরি করা হয়েছিল। সহিংসতা কখনোই হঠাৎ জন্ম নেয় না—এই সত্যটি এখানে আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দিনের পর দিন অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানো, নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, ‘শত্রু’ চিহ্নিত করার রাজনীতি—এসব মিলেই তৈরি হয় সেই পরিবেশ, যেখানে এক রাতে আগুন জ্বালাতে মানুষ দ্বিধা করে না। নাহিদ ইসলামের ভাষায়, রাজনৈতিক ব্যাকআপ, সামাজিক সম্মতি আর রাষ্ট্রের ভেতরের অংশের নীরবতা—এই তিনটি একসঙ্গে না হলে এমন সাহস কেউ পেত না।
এই বক্তব্য শুধু সরকারের দিকে আঙুল তোলাই নয়, নিজেদের দিকেও তাকানোর আহ্বান। নাহিদ ইসলাম স্বীকার করেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শক্তিগুলোরও দায় আছে। এই স্বীকারোক্তি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে দায় স্বীকারের সংস্কৃতি প্রায় নেই বললেই চলে। ক্ষমতায় থাকলে সব কৃতিত্ব নিজের, আর বিপদ এলে সব দায় অন্যের—এই সহজ সমীকরণে রাজনীতি চলে। কিন্তু এখানে তিনি বলছেন, পরিবর্তনের আন্দোলনে যারা ছিল, তারাও সমাজকে কোথাও না কোথাও এমন জায়গায় এনে ফেলেছে, যেখানে সহিংসতা জায়গা করে নিতে পেরেছে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনা ছিল শুধু দুটি ভবনের ওপর আক্রমণ নয়; এটি ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর সরাসরি আঘাত। একটি রাষ্ট্রে যখন গণমাধ্যম নিরাপদ না থাকে, তখন নাগরিকের নিরাপত্তাও টেকসই হয় না—এই সম্পর্কটা খুব পুরোনো। সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন করে, ক্ষমতার জবাবদিহি চায়, আর সেই কারণেই তারা বারবার আক্রমণের শিকার হয়। সেই রাতে যা ঘটেছে, তা ‘মব’ শব্দ দিয়ে যত সহজে বোঝানো হয়, বাস্তবে তা ছিল পরিকল্পিত সন্ত্রাস। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট—সবই হয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
এই ঘটনার পর সবচেয়ে বিব্রতকর প্রশ্নটি উঠে আসে নিরাপত্তা নিয়ে। নাহিদ ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ঢাকা শহরে কি ৫০০ মানুষও নেই, যারা ওই দুই ভবনের সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দিতে পারত? এই প্রশ্ন শুধু নাগরিক সমাজের নিষ্ক্রিয়তার দিকে ইঙ্গিত করে না, বরং রাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়েও বড় প্রশ্ন তোলে। একটি রাজধানী শহরে, শীর্ষ সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের সামনে, দীর্ঘ সময় ধরে হামলা চলবে—আর তা ঠেকানোর মতো কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকবে না—এটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না।
এই নীরবতা বা নিষ্ক্রিয়তা আসলে নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আমরা দেখেছি, কীভাবে সহিংসতা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কখনো ধর্ম অবমাননার অভিযোগে, কখনো মতাদর্শিক বিরোধে, কখনো নিছক গুজবের ভিত্তিতে মানুষকে আক্রমণ করা হয়েছে। প্রতিবারই রাষ্ট্র বলেছে, ‘তদন্ত হবে’। কিন্তু তদন্তের ফল কী, বিচার কতদূর—সেই হিসাব খুব কমই জনসমক্ষে আসে। ফলে মব বুঝে যায়, ঝুঁকি কম, লাভ বেশি।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলার পর যেভাবে ছায়ানট, উদীচীসহ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেও আক্রমণ হয়েছে, তা দেখিয়ে দেয় এই সহিংসতার লক্ষ্য কতটা বিস্তৃত। এটি শুধু সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নয়; এটি মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতি ও ভিন্নমতের বিরুদ্ধে। যে কোনো সমাজে যখন সাংস্কৃতিক পরিসর সংকুচিত হতে থাকে, তখন সেটি গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। কারণ সংস্কৃতিই মানুষের ভাবনার ভাষা তৈরি করে, আর সেই ভাষা থেমে গেলে ক্ষমতার প্রশ্ন তোলার শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই প্রেক্ষাপটে নাহিদ ইসলামের দাবি—সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার—শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তদন্ত মানে শুধু কয়েকজনকে আটক করা নয়; তদন্ত মানে হলো পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা ও নীরব সমর্থকদের চিহ্নিত করা। আর বিচার মানে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ভাবার সাহস না পায়—মব নামলেই সব পার পাওয়া যাবে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই দাবি বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে? বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, বড় ঘটনার পর কিছুদিন আলোচনা হয়, সভা-সমাবেশ হয়, বিবৃতি আসে। তারপর ধীরে ধীরে সব চাপা পড়ে যায়। নতুন কোনো সংকট আগেরটিকে ঢেকে দেয়। কিন্তু প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলা যদি সত্যিই ‘গণমাধ্যমের জন্য কালো দিন’ হয়ে থাকে, তাহলে এই ঘটনাকে ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। ভুলে গেলে সেটাই হবে হামলাকারীদের সবচেয়ে বড় জয়।
এই হামলার মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—ভয়ের রাজনীতি এখন আর শুধু রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের নানা স্তরে। কখনো উগ্র ধর্মীয় আবেগ, কখনো জাতীয়তাবাদের মোড়কে, কখনো তথাকথিত দেশপ্রেমের নামে—সহিংসতা নানা রূপে হাজির হচ্ছে। আর এই সহিংসতার সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে স্বাধীন চিন্তা ও প্রশ্ন করার অধিকার।
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের সভাকক্ষ থেকে যখন বক্তারা বেরিয়ে রাস্তায় মানববন্ধনে দাঁড়ান, সেটি ছিল প্রতীকী এক দৃশ্য। বিলাসী হোটেল আর রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে দূরত্ব যেমন আছে, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র আর সাধারণ নাগরিকের বাস্তবতার মধ্যেও গভীর ফাঁক রয়েছে। সেই ফাঁক যতদিন থাকবে, ততদিন মব সহিংসতা নতুন নতুন রূপে ফিরে আসবে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনা তাই শুধু একটি সংবাদ নয়, এটি একটি সতর্কবার্তা। গণমাধ্যম আক্রান্ত হলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়, আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে নাগরিকের নিরাপত্তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। নাহিদ ইসলামের বক্তব্য সেই বাস্তবতাকেই স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছে—এই সহিংসতার পেছনে হাত আছে, মাথা আছে, পরিকল্পনা আছে। এখন প্রশ্ন একটাই—রাষ্ট্র কি সেই হাত ও মাথাকে চিহ্নিত করার সাহস দেখাবে, নাকি আবারও ইতিহাসের মতো নীরব থেকে সহিংসতাকে স্বাভাবিক হতে দেবে?
আপনার মতামত জানানঃ