ডিসেম্বর সাধারণত এই ভূখণ্ডে একধরনের আশ্বাস নিয়ে আসে। শীতের হালকা ছোঁয়া, বিজয়ের স্মৃতি, অতীতের রক্তঝরা পথ পেরিয়ে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস—সব মিলিয়ে এই মাস মানুষের মনে কিছুটা হলেও ভরসা জাগায়। এবছরও ব্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনেকেই ভেবেছিলেন, দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর অন্তত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হবে। নির্বাচন কমিশনের আশ্বাস, বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোতায়েন—সব মিলিয়ে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই স্বস্তি টিকল না এক দিনের বেশি। তফসিল ঘোষণার পরদিনই ঢাকার বিজয়নগরে প্রকাশ্য রাস্তায় মাথায় গুলি করে হত্যা করা হলো ওসমান হাদিকে। সেখান থেকেই যেন আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল—এই দেশে আশার আয়ু বড়ই কম।
ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাজনৈতিক কর্মী বা সম্ভাব্য প্রার্থীর মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও সদিচ্ছার ওপর সরাসরি আঘাত। গুলি করার পরপরই ঘাতকদের ছবি, নাম, পরিচয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল।
তবু প্রধান আসামিরা সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে গেল, আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখল—এই ধারণাই জনমনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিল। সেই ক্ষোভ ধীরে ধীরে হতাশায় রূপ নিল, আর হতাশার ফাঁক গলে মাথাচাড়া দিল নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠী। তারা বুঝে গেল, এই মুহূর্তে রাষ্ট্র নীরব, আইন দুর্বল, আর ভয় ছড়ানোর সুযোগ অফুরন্ত।
এরপরের ঘটনাগুলো যেন ডমিনো ইফেক্টের মতো একটির পর একটি পড়ে যেতে লাগল। গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলা হলো, সাংবাদিকরা কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়লেন। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে যদি দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম নিরাপদ না থাকে, তাহলে মফস্বল বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। অথচ এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই ঘটেছে। ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ—সবই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, কিন্তু প্রতিরোধ নেই, জবাবদিহি নেই। যেন কেউ সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এই সময় রাষ্ট্র দেখবে, কিন্তু করবে না।
হাসিনার শাসনামলে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার উৎস ছিল রাষ্ট্র নিজেই—এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায়নি। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডিজিটাল নজরদারি—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রই হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের নাম। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন রকম। এখন রাষ্ট্র পেছনে সরে গেছে, আর সামনে এসেছে মব। অনলাইন আর অফলাইনে গড়ে ওঠা উন্মত্ত জনতা, যারা বিচারক, জল্লাদ আর রায় কার্যকরকারী—সব একসঙ্গে। কারও মত পছন্দ হলো না, পোশাক ভালো লাগল না, ধর্ম বা রাজনীতির তকমা সাঁটিয়ে দিলেই যথেষ্ট। এরপর শুরু হয় পিটুনি, লাঞ্ছনা, হত্যাকাণ্ড। দায় নেবে কে? সবাই বলে, ‘জনতা করেছে’—এই ‘জনতা’ শব্দটাই যেন সবচেয়ে বড় দায়মুক্তির চাদর।
গত ষোলো মাসে দেশের নানা প্রান্তে মাজার, দরগাহে হামলা হয়েছে। বাউলদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো বিভীষিকাময় ঘটনাও ঘটেছে। নারীরা পথে-ঘাটে, কর্মস্থলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছেন বারবার। প্রতিবারই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ থেকেছে বিবৃতি আর প্রতীকী গ্রেপ্তারে। এর ফলে একটি ভয়ংকর বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে—যারা সহিংস, তারা শক্তিশালী; যারা আইন মানে, তারা অসহায়।
এই দায়মুক্তির সংস্কৃতির সবচেয়ে নির্মম উদাহরণ হয়ে উঠল ময়মনসিংহের ভালুকার পোশাকশ্রমিক দীপু দাসের হত্যাকাণ্ড। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি, যাঁর ঘরে একটি দেড় বছরের শিশুকন্যা, তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো প্রকাশ্যে। শুধু হত্যা নয়—বিবস্ত্র করে লাশ ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও সেই নৃশংসতার প্রমাণ বহন করে। অভিযোগ—ধর্ম অবমাননা। কিন্তু সেই অভিযোগ কী, কে করেছে, কী প্রমাণ—সবই অস্পষ্ট। যদি অপরাধ থেকেও থাকে, তাহলে কি আইনের আশ্রয় নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না? রাষ্ট্র কি এতটাই অক্ষম যে একজন শ্রমিকের জীবন রক্ষা করতে পারে না?
দীপুর স্ত্রীর আহাজারি, বাবার নির্বাক মুখ, শিশুকন্যার ভবিষ্যৎ—এসব প্রশ্ন রাষ্ট্রকে কেউ জোরে শুনতে বাধ্য করছে না। র্যাব ও পুলিশ কয়েকজনকে আটক করেছে, কিন্তু তাতেই কি দায় শেষ? যারা মব উসকে দিল, যারা ভিডিও করল, যারা দাঁড়িয়ে দেখল—তাদের দায় কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না থাকাই সবচেয়ে ভয়ংকর। কারণ উত্তরহীন প্রশ্নই ভবিষ্যতের আরও সহিংসতার জমি তৈরি করে।
এর ঠিক পরদিনই লক্ষ্মীপুরে ঘটে গেল আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। গভীর রাতে একটি ঘরে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। বড় দুই মেয়ে আর স্ত্রী কোনোভাবে বেরিয়ে এলেও সাত বছরের আয়েশা আক্তার পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। কী অপরাধ ছিল তার? কোন রাজনীতি, কোন ধর্ম, কোন মতাদর্শ তাকে মৃত্যুদণ্ড দিল? মা-বাবার চোখের সামনে শিশুটির চিৎকার থেমে যাওয়ার সেই দৃশ্য কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না। অথচ এই দেশেই তা বাস্তব।
দীপু দাস আর আয়েশা আক্তার—দুজনেই আলাদা প্রেক্ষাপটের শিকার, কিন্তু মূল কারণ একটাই: রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা। রাষ্ট্র যখন ভুলে যায় যে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তার প্রধান দায়িত্ব, তখন সমাজে নেমে আসে আইনহীনতা। তখন শক্তিশালী হয় মব, দুর্বল হয় সাধারণ মানুষ। তখন কেউ আর নিরাপদ থাকে না—না শ্রমিক, না শিশু, না সাংবাদিক, না সংখ্যালঘু।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে—এই মৃত্যু থামাবে কে? কার কাছে বিচার চাইবে দীপুর পরিবার, আয়েশার বাবা-মা? রাষ্ট্র যদি নীরব থাকে, যদি শুধু পরিস্থিতি ‘পর্যবেক্ষণ’ করেই সময় কাটায়, তাহলে এই সহিংসতা থামবে না। বরং প্রতিটি নীরবতা নতুন এক হত্যাকাণ্ডের অনুমতি হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস আমাদের বারবার শিখিয়েছে—দায়মুক্তি কখনো স্থিতি আনে না, আনে আরও রক্ত।
অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতার প্রশ্ন আজও প্রাসঙ্গিক—‘কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও?’ এই প্রশ্ন শুধু কবিতার নয়, এটি আজ বাংলাদেশের নাগরিকের প্রশ্ন। আমরা সবাই জানি, এই মৃত্যুগুলো থামাতেই হবে। কিন্তু যতক্ষণ না রাষ্ট্র তার দায়িত্ব স্মরণ করে, যতক্ষণ না আইনের শাসন মবের ওপর প্রাধান্য পায়, ততক্ষণ এই প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে যাবে। আর সেই অজানার ভেতরেই হারিয়ে যাবে আরও দীপু, আরও
আপনার মতামত জানানঃ