
ভালুকার সেই রাতটি শুরু হয়েছিল অন্য যেকোনো কর্মদিবসের মতোই। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ডুবুলিয়া এলাকার একের পর এক কারখানায় ছুটির ঘণ্টা বাজছিল, শ্রমিকেরা বেরিয়ে আসছিল গেট দিয়ে, কেউ ফিরছিল মেসে, কেউবা চায়ের দোকানে। এই চেনা ছবির মধ্যেই ধীরে ধীরে জমে উঠছিল এক অস্বস্তিকর উত্তেজনা, যার পরিণতি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রূপ নেয় এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে। ময়মনসিংহের ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক তরুণ পোশাক শ্রমিক, দিপু চন্দ্র দাস, ধর্ম অবমাননার অভিযোগের গুজবের জেরে দলবদ্ধ মারধর ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যার শিকার হন।
দিপু চন্দ্র দাসের বয়স ছিল আনুমানিক ২৮ বছর। জেলার তারাকান্দা থানার বাসিন্দা হলেও কাজের প্রয়োজনে তিনি ভালুকার ডুবুলিয়া এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি ডুবুলিয়া পাইওনিয়ার নিট ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। পরিবার থেকে দূরে থাকা এই তরুণের জীবনে ছিল স্বাভাবিক শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন—স্থায়ী কাজ, মেয়ের ভবিষ্যৎ, একটু ভালো জীবনের আশা। দেড় বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান ছিল তার, যে বাবার সঙ্গে খুব কম সময়ই কাটাতে পেরেছে।
ঘটনার সূত্রপাত নিয়ে যে বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়, বরং নানা স্তরের অস্পষ্টতা ও গুজবে ভরা। র্যাব, পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার বিকেলের পর ফ্যাক্টরির ভেতরে দিপু চন্দ্র দাসকে ঘিরে উত্তেজনা শুরু হয়। কয়েকজন শ্রমিক তার বিরুদ্ধে নবী ও ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ তোলেন। বলা হয়, তিনি নাকি চায়ের দোকানে বসে এমন মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বা প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। র্যাবের কোম্পানি কমান্ডার মো. সামসুজ্জামান পরে বিবিসি বাংলাকে জানান, যারা অভিযোগ করছেন, তাদের কেউই বলেননি যে তারা নিজের কানে বা চোখে এমন কিছু শুনেছেন বা দেখেছেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দিপুর পক্ষ থেকে কোনো আপত্তিকর পোস্ট বা মন্তব্যের প্রমাণ মেলেনি।
অভিযোগটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। ফ্যাক্টরির ভেতরে এক পর্যায়ে দিপুকে মারধর শুরু হয়। উত্তেজিত শ্রমিকদের চিৎকার, ধর্ম অবমাননার অভিযোগের স্লোগান এবং ভয়ের পরিবেশে পুরো কারখানা এলাকা অস্থির হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার সময়টি ছিল কারখানাগুলোর ছুটি হওয়ার মুহূর্ত, ফলে বাইরেও অল্প সময়ের মধ্যে বহু মানুষ জমায়েত হতে থাকে। কেউ কেউ বাইরে থেকে দাবি জানাতে থাকেন, দিপুকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।
এই সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপনার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। র্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি ‘টালমাটাল’ হয়ে গেলে ফ্যাক্টরি রক্ষার কথা ভেবে দিপু চন্দ্র দাসকে বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রডাকশন ম্যানেজার তাকে তাৎক্ষণিক বরখাস্তও করেন বলে জানা যায়। কারও কারও বক্তব্য, ফ্যাক্টরির ভেতরে মারধরের এক পর্যায়ে একটি পকেট গেট দিয়ে বাইরের লোকজন ঢুকে তাকে টেনে বের করে নিয়ে যায়। যে বর্ণনাই সত্য হোক না কেন, বাস্তবতা হলো—দিপু চন্দ্র দাসকে নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে তাকে উত্তেজিত জনতার সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ফ্যাক্টরি থেকে বের করে আনার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর, স্কয়ার মাস্টারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকার আইল্যান্ডে তাকে মারধর করা হয়। দেশীয় অস্ত্র, লাঠি, কিলঘুষির আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। এক পর্যায়ে তাকে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে আগুনে রশি ছিঁড়ে গেলে তার দেহ নিচে পড়ে যায়। এই নির্মম দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে নানা দাবি ও পাল্টা দাবি ছড়াতে থাকে। কেউ কেউ বলেন, দিপু আক্রান্ত অবস্থায় পুলিশের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরে তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। তার ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশকে খবরই দেওয়া হয় অনেক দেরিতে, এবং দিপুকে সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকেই তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। র্যাবও জানায়, বিকেল পাঁচটার দিকে ঘটনা শুরু হলেও পুলিশকে জানানো হয় রাত আটটার দিকে।
এই দেরির বিষয়টি পুরো ঘটনার আরেকটি গুরুতর দিক উন্মোচন করে। কয়েক ঘণ্টা ধরে উত্তেজনা, মারধর ও সহিংসতার মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। কেন এত দেরিতে পুলিশকে জানানো হলো, কেন ফ্যাক্টরির ভেতরেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হলো না—এই প্রশ্নগুলো এখন তদন্তের কেন্দ্রে।
ঘটনার ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে র্যাব প্রথমে দুজনকে আটক করে, পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আরও পাঁচজনকে আটক করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকেও তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়েছে এবং মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে গ্রেপ্তারের সংখ্যার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, এই সহিংসতায় জড়িতদের প্রকৃত সংখ্যা কত এবং এর পেছনের সামাজিক মনস্তত্ত্ব কী।
নিহত দিপু চন্দ্র দাসের পরিবার এখন শোকে স্তব্ধ। তার চাচাতো ভাই কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, ভিডিওতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারা কী করেছে। তাদের দাবি, দিপুকে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। এলাকায় যারা দিপুকে চিনতেন, তারা জানতেন তিনি কেমন মানুষ। পরিবারের পক্ষ থেকে শুধু একটাই দাবি—ন্যায়বিচার। কী ঘটেছিল ফ্যাক্টরির ভেতরে, সেই খুঁটিনাটি তারা প্রকাশ করতে চান না, তবে তাদের বিশ্বাস, সেখানেই ঘটনার মূল সূত্র লুকিয়ে আছে।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন ব্যক্তির প্রাণহানি নয়; এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে ওঠা মব সহিংসতার ভয়াবহ উদাহরণ। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ, সত্য-মিথ্যার যাচাই ছাড়াই, মুহূর্তের মধ্যে এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো মানসিকতা কীভাবে গড়ে উঠছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। র্যাবের কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, ধর্ম অবমাননার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবু গুজবই যথেষ্ট হয়েছে একজন মানুষকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারার জন্য।
অন্তর্বর্তী সরকার এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই এবং এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এই বক্তব্য আশ্বাস দিলেও বাস্তবতা হলো, দেশে মব সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ দীর্ঘদিনের। মানবাধিকার সংগঠনগুলো আগেও বারবার সতর্ক করেছে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সমাজকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।
ভালুকার ঘটনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংখ্যালঘু পরিচয়ের প্রশ্ন। দিপু চন্দ্র দাস ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে সরাসরি ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং ধর্ম অবমাননার অভিযোগের গুজব কাজ করেছে, তবু বাস্তবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে, গুজব ও উত্তেজনা কত দ্রুত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, এই ঘটনা তার উদাহরণ।
এই ঘটনার পর ভালুকা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি হয়। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, কর্মস্থলে যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবে শ্রমিকদের রক্ষা করার দায় কার? ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন, না কি রাষ্ট্র নিজে? দিপু চন্দ্র দাসকে বাইরে ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তা শুধু একটি প্রশাসনিক ভুল নয়, বরং একটি মারাত্মক মানবিক ব্যর্থতা।
ভালুকার সেই রাতের ভিডিওগুলো হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফিড থেকে হারিয়ে যাবে, কিন্তু যে প্রশ্নগুলো রেখে গেছে, সেগুলো সহজে মুছে যাওয়ার নয়। একজন তরুণ শ্রমিক, একজন বাবা, একজন স্বামী—কয়েক ঘণ্টার গুজব ও উত্তেজনার শিকার হয়ে প্রাণ হারালেন। তার দেড় বছরের মেয়েটি বড় হবে বাবার মুখ মনে না রেখেই। পরিবারটি সারাজীবন বয়ে বেড়াবে এক অসম্পূর্ণতার বোঝা।
এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কেবল আদালতের রায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। সমাজ হিসেবে আমাদেরও আত্মসমালোচনা দরকার—কেন আমরা গুজবে এত দ্রুত বিশ্বাস করি, কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করি না, কেন ভিন্ন পরিচয় বা ভিন্ন বিশ্বাসকে সহজেই শত্রুতে পরিণত করি। ভালুকার ঘটনায় যদি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়, তবে তা হয়তো ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা দেবে। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি হলো, এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে কোনো দিপু চন্দ্র দাসকে আর গুজবের আগুনে পুড়ে মরতে হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ