মুক্তিযুদ্ধ ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ করার প্রশ্নটি তুললেই একটি সংবেদনশীল জায়গায় পৌঁছাতে হয়—বাংলাদেশের পক্ষের কেউ কি এমন কিছু করেছিলেন, যার ফলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়েছে? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই প্রশ্নের সরল “হ্যাঁ” বা “না” উত্তর নেই। তবে কিছু বাস্তবতা ও সিদ্ধান্ত ছিল, যেগুলো যুদ্ধের গতি প্রভাবিত করেছে, যদিও সেগুলোর পেছনে দেশবিরোধী উদ্দেশ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যত ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বড় অংশ ভারতে আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে একটি কার্যকর কমান্ড স্ট্রাকচার গড়ে তুলতে সময় লেগেছে। এপ্রিলের ১০ তারিখ অস্থায়ী সরকার গঠিত হলেও পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক ও সামরিক সমন্বয় বাস্তবে শুরু হয় আরও পরে। এই বিলম্ব অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতিগত, কিন্তু এর ফলে যুদ্ধ দ্রুত সংগঠিত রূপ পায়নি—এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নেতৃত্বের ভেতরে কৌশলগত মতভেদ। কিছু রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা চাইছিলেন দ্রুত সম্মুখযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দিকে যেতে, আবার কেউ কেউ গেরিলা যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে চালিয়ে পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে দুর্বল করার পক্ষে ছিলেন। এই মতভেদ কখনো কখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্লথতা এনেছে। তবে এটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধ দীর্ঘ করার ষড়যন্ত্র বলা যায় না; বরং এটি ছিল সীমিত সম্পদ ও অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ভিন্ন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির ফল।
এমন অভিযোগও শোনা যায় যে কিছু স্থানীয় রাজনীতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের ক্ষমতা ও অবস্থান ধরে রাখতে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছেন। গবেষণা ও স্মৃতিকথায় দেখা যায়, কিছু এলাকায় ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি বা প্রতিদ্বন্দ্বী দমন করার ঘটনা ঘটেছিল। তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কৌশল নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে—এমন কোনো শক্ত প্রমাণ ইতিহাস দেয় না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—কোনো বাংলাদেশি নেতৃত্ব কি সচেতনভাবে পাকিস্তানের স্বার্থে যুদ্ধ দীর্ঘ করতে চেয়েছিলেন? এ বিষয়ে প্রামাণ্য দলিল, সরকারি নথি বা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বরং দেখা যায়, বাংলাদেশের পক্ষের প্রধান লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন নিশ্চিত করা, একটি কার্যকর সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা এবং ভারতের সরাসরি সহযোগিতার উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করা। এই অপেক্ষা কৌশলগত ছিল, ষড়যন্ত্রমূলক নয়।
ডিসেম্বর মাসে ভারতের সরাসরি সামরিক অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এটি প্রমাণ করে যে যুদ্ধ দীর্ঘ হওয়ার মূল কারণ ছিল শক্তির অসমতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি—বাংলাদেশের পক্ষের ইচ্ছাকৃত বিলম্ব নয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ হয়েছিল নানা বাস্তব সীমাবদ্ধতা, কৌশলগত প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সমীকরণের কারণে। বাংলাদেশের পক্ষের ভেতরে ভুল, দুর্বলতা বা মতভেদ ছিল—এ কথা ইতিহাস অস্বীকার করে না। কিন্তু যুদ্ধ ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ করার মতো দেশবিরোধী পরিকল্পনায় বাংলাদেশের পক্ষের কারও জড়িত থাকার প্রমাণ ইতিহাস দেয় না।
আপনার মতামত জানানঃ