যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির ধাক্কায় ভারতের রপ্তানি যে সংকটে পড়েছে, তার গভীরতা এখন কেবল পরিসংখ্যানের খাতায় নয়, দেশের লাখো কারখানা, গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকবাড়ি আর শহুরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দুঃস্বপ্নে ফুটে উঠছে। বহু বছর ধরে ভারতীয় পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিল। কম দাম, স্থিতিশীল সরবরাহব্যবস্থা এবং শ্রমনির্ভর উৎপাদনশীল খাত ভারতকে সেখানে প্রতিযোগিতায় সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ২৫ থেকে ৫০ শতাংশে শুল্ক বাড়ার ফলে পরিস্থিতি এমনভাবে বদলে গেছে যে ভারতের রপ্তানি এখন নিজ দেশের শিল্পকে রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত, আর মার্কিন বাজার ধরে রাখার প্রশ্নটি ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
গত দুই দশকে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধির যাত্রা সহজ ছিল না। ২০০৫ সালে বৈশ্বিক রপ্তানিতে ভারতের অংশ ছিল মাত্র ১.২ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ২.৪ শতাংশে। সংখ্যাটি ক্ষুদ্র মনে হলেও প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক বাণিজ্যে এটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই অগ্রগতি এসেছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের পরিশ্রম, নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা এবং রপ্তানিকারকদের ধারাবাহিক বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার ফলে দুই দশকের এই অর্জন মুহূর্তে যেভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে, তা ভারতের অর্থনীতিতে বড় ধরনের কাঁপুনি ধরিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি-আমদানি ঘাটতি বেড়ে ৩২.১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো এর বড় প্রমাণ, যা গত ১৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ৬.৯ বিলিয়ন থেকে নেমে আসে ৫.৪ বিলিয়ন ডলারে। অক্টোবরের চিত্র আরও মলিন—গত বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পণ্য রপ্তানি ৯ শতাংশ কমে গেছে।
এই সংকটের সবচেয়ে তীব্র অভিঘাত পড়েছে শ্রমনির্ভর খাতগুলোতে। টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, চামড়া, জুতা, রত্ন ও গয়না এবং হস্তশিল্প—এগুলো এমন সেক্টর, যেখানে কোটি মানুষ কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত, যাদের বড় অংশ নারী শ্রমিক। ভারতের বহু অঞ্চলেই এই শিল্পগুলো শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতারও চালিকাশক্তি। অথচ শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এসব খাত যেন দম বন্ধ অবস্থায়। উৎপাদন বাড়ালে রপ্তানি সম্ভব নয়, আবার উৎপাদন কমালে শ্রমিক ছাঁটাই ছাড়া উপায় থাকবে না—এই দোদুল্যমান বাস্তবতায় উদ্যোক্তারা এখন কার্যত বন্দী।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লেগেছে কার্পেট ও গালিচা শিল্পে। যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যের ভারতের সবচেয়ে বড় বাজার, যেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ রপ্তানি যেত। কিন্তু শুল্ক ২.৯ শতাংশ থেকে এক লাফে ৫২.৯ শতাংশে উঠে যাওয়ায় মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা দ্রুতই ভারত ছাড়ছে এবং সস্তা বিকল্প হিসেবে তুরস্ক, চীন কিংবা মিসরে তুরস্কের মালিকানাধীন কারখানার দিকে ঝুঁকছে। একটি শিল্প যখন বছরের পর বছর ধরে দক্ষ কারিগর তৈরি করে, যখন একটি অঞ্চলের অর্থনীতি প্রায় পুরোপুরি একটি নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে যায়, তখন বাজার হারানোর মানে শুধু সংখ্যা নয়—মানুষের জীবনযাপন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়।
টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক শিল্পেও সেই একই গল্প। ভারত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ১০.৯ বিলিয়ন ডলারের বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানি করেছিল, যা মোট রপ্তানির ৩৫ শতাংশ। এই খাতে লাভের হার এমনিতেই খুব কম, অনেক ক্ষেত্রে ৫–৮ শতাংশের মতো। ফলে শুল্ক ১৩.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৩.৯ শতাংশে পৌঁছানো মানে ভারতীয় পোশাক কার্যত মার্কিন বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়া। এই শূন্যস্থানটি ভরাট করছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম—যারা তুলনামূলক কম খরচে, উচ্চ দক্ষতায় এবং দ্রুত সরবরাহব্যবস্থায় মার্কিন ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করছে। পাকিস্তানও ডেনিম ও ফ্লিস উৎপাদনে নতুন করে অবস্থান শক্ত করছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়া ফ্যাশন পণ্যে নতুন হাব হয়ে উঠছে। অর্থাৎ ভারতের সামনে প্রতিযোগীরা শুধু বাড়ছে না, নিজেদের উপস্থিতিও স্থায়ী করে তুলছে।
বাজার হারানোর এই আশঙ্কা কেবল দূরভবিষ্যতের একটি উদ্বেগ নয়। এখনই নতুন অর্ডার কমে আসছে, অনেক অঞ্চলে কারখানায় কর্মঘণ্টা কমছে, কোথাও কোথাও ছাঁটাই শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডগুলো ক্রমেই মেক্সিকো ও সিএএফটিএ–ডিআর জোটভুক্ত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে, যাদের ভৌগোলিক অবস্থান সুবিধাজনক এবং যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারও রয়েছে। এমন বাজার যখন একবার সরবরাহব্যবস্থা বদলে ফেলে, তখন আগের সরবরাহকারীর কাছে ফিরে আসার সুযোগ অনেক কমে যায়।
ভারতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। ২০২৪–২৫ সালে মোট রপ্তানির ২১.৮ শতাংশ গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এই বাজার এখন কার্যত বন্ধ। উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে হাজার হাজার ছোট চামড়া কারখানা এবং ট্যানারি রয়েছে, যেখানে কর্মরত শ্রমিকেরা আজ অনিশ্চয়তার মুখে। বহু পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য বাজার হারানোর মানে শুধু আর্থিক সংকট নয়, দক্ষতার অবমূল্যায়ন এবং বিকল্প জীবিকার অভাব।
সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত লেগেছে রত্ন ও গয়না শিল্পে। মুম্বাইয়ের এসইইপিজেড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রত্ন ও গয়নার রপ্তানি সেপ্টেম্বর মাসে আগের বছরের তুলনায় ৭১–৭৬ শতাংশ কমে গেছে। গয়না শিল্পে হাজার হাজার কারিগর, পলিশ শ্রমিক, ছোট উদ্যোক্তা কাজ করে থাকেন। অর্ডার কমে যাওয়ায় তারা এখন বাস্তবিক অর্থেই জীবিকার সঙ্কটে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের গয়না শিল্প দক্ষ কারিগর ও শিল্পনৈপুণ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এই শিল্পে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। ফলে হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি এই শিল্পকে গভীর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে।
কিছু রপ্তানিকারক অবশ্য শুল্ক বাড়ার আগেই সম্ভাব্য ধাক্কা অনুমান করে বেশি পরিমাণে পণ্য পাঠানোর কৌশল নিয়েছিলেন। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের মোট রপ্তানি ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর এই বাড়তি গতি এখন থমকে গেছে। আগের ‘বাফার শিপমেন্ট’ সাময়িক স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে কোনো সমাধান দেয়নি।
এই সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতের সামনে দুটি মূল পথ খোলা—একটি তাৎক্ষণিক প্রতিকার, অন্যটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিবর্তন। তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ক্ষেত্রে ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে কোনোভাবে শুল্ক কমানোর বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে, তাহলে কিছুটা শ্বাস ফেলার সুযোগ মিলতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের নীতি যে স্বল্পমেয়াদে পরিবর্তিত হবে না, তার ইঙ্গিত ট্রাম্প বহুবার দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বাণিজ্যকে তিনি ভূরাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে দেখবেন।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ক্ষেত্রে বহুমুখীকরণই ভারতের সবচেয়ে বড় পথ। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর বাজারে প্রবেশের মতো সুযোগ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে পোশাক, চামড়া, খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং হস্তশিল্পের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ভারত চাইলে এই নতুন বাজারগুলোতে দ্রুত উপস্থিতি বাড়াতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সঙ্গে আঞ্চলিক টেক্সটাইল ও পোশাক সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারত যদি দক্ষিণ এশিয়াকে একটি একীভূত উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং দ্বিপক্ষীয় অস্থিরতা বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে।
ভারতের রপ্তানিনির্ভর শিল্প আজ যে সংকটে পড়েছে, তা কেবল একটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ নয়; এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নতুন বাস্তবতা। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি যখন নিজেদের বাজার রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেয়, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাজার ধরে রাখার লড়াই কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতের বর্তমান সংকট দেখায়, একক বড় বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। ভবিষ্যতে যদি শুল্ক কমেও, ভারতের জন্য আগের বাজার ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না—কারণ সরবরাহব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নতুন অবস্থানে সরে যেতে শুরু করেছে।
এই সময়ে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে শিল্পকে টিকিয়ে রাখা, শ্রমিকদের আয়-রোজগার রক্ষা করা এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করা। ভারত একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কম নির্ভরশীল ছিল। আবারও সেই পথেই ফিরে যেতে হতে পারে—বহুমুখীকরণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে। আজকের সংকট ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হতে পারে, যদি ভারত এই ধাক্কাকে একটি রূপান্তরের সুযোগ হিসেবে নিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ