
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখন যেভাবে জনমত গঠিত হচ্ছে, সেখানে পুলিশের ভূমিকা আবারও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নির্বাচনের পূর্ব প্রস্তুতি, এবং অপরাধ দমনে ব্যর্থতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমের দায়িত্ব গ্রহণ অনেকেই এক ধরনের ‘শেষ সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন—একটি অগোছালো ও অবিশ্বাসে নিমজ্জিত বাহিনীকে পুনর্গঠনের সুযোগ। কিন্তু এই পরিবর্তনের সময়টি যতটা প্রয়োজনীয়, ততটাই জটিল।
দেশজুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব এবং গণঅসন্তোষের মধ্যে পুলিশ বর্তমানে এক গভীর আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে। জনমানুষের চোখে এই বাহিনী এখন আর কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী নয়—বরং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। গত সরকারের সময় নানা অভিযানে পুলিশ যে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বা রাজনৈতিক আনুগত্যের অভিযোগে জড়িয়েছে, তার ছাপ এখনো কাটেনি। এই প্রেক্ষাপটে নতুন আইজিপির দায়িত্ব অত্যন্ত কঠিন—একদিকে বাহিনীর শৃঙ্খলা ও মনোবল পুনরুদ্ধার, অন্যদিকে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
বাহারুল আলম নিজে একজন পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার অধিকারী। কিন্তু অভিজ্ঞতা এক জিনিস, বাস্তবতা আরেক। বর্তমানে পুলিশ বাহিনী একদিকে প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের মুখে—সাইবার অপরাধ, সংগঠিত অপরাধ, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের প্রভাব—অন্যদিকে মানবসম্পদ, প্রশিক্ষণ ও জনসংযোগের দিক থেকে এখনো অতীতমুখী। অনেক কর্মকর্তাই এখনও মনে করেন, “আইন প্রয়োগ মানে শক্তি প্রয়োগ।” এই মানসিকতা ভাঙা ছাড়া কোনো প্রকৃত সংস্কার সম্ভব নয়।
আইজিপির সাম্প্রতিক বক্তব্যে দেখা যায়, তিনি বাহিনীকে “জনবান্ধব” করার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে? দীর্ঘদিনের দমনমূলক মনোভাব, ঘুষ ও প্রভাববিস্তারমূলক নিয়োগব্যবস্থা, এবং তৃণমূল পর্যায়ে জবাবদিহিতার অভাব—এসব একদিনে বদলানো সম্ভব নয়। দেশের থানাগুলো আজও এমনভাবে পরিচালিত হয় যেন সেগুলো নাগরিকের সেবাকেন্দ্র নয়, বরং প্রশাসনিক কোর্ট। ফলে সাধারণ মানুষ থানায় যেতে ভয় পায়, অভিযোগ করতে দ্বিধা করে, আর অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী পুলিশ ব্যবস্থাকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে।
অন্যদিকে, সরকারের ওপরও এই সংস্কারের একটি বড় দায়িত্ব বর্তায়। কারণ পুলিশ বাহিনী যতই পেশাদার হতে চায় না কেন, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জাল থেকে বের হতে না পারলে সেই চেষ্টা ব্যর্থই থেকে যাবে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, সরকারের নীতি বা রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হলে পুলিশ প্রশাসন নিজেকে নিরপেক্ষ রাখতে পারে না। এটি শুধু বাহিনীর নয়, রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নও হয়ে দাঁড়ায়।
তাছাড়া, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশের ভূমিকা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে, পুলিশকে একইসঙ্গে দৃঢ় এবং ন্যায্য হতে হবে। এটাই হলো সেই সূক্ষ্ম ভারসাম্য, যা না থাকলে আবারও আগের মতোই অভিযোগ উঠবে—দমন, পক্ষপাত, এবং নির্বাচনী সহিংসতা। বাহারুল আলমের ওপর এই চাপ সবচেয়ে বেশি—কারণ একদিকে তাকে রাজনৈতিক প্রত্যাশা সামলাতে হবে, অন্যদিকে জনআস্থার ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
তবে এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সুযোগ আছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, সাইবার মনিটরিং, ডেটা-ভিত্তিক অপরাধ বিশ্লেষণ, এবং প্রশিক্ষণ-নির্ভর পেশাগত উন্নয়নের মাধ্যমে পুলিশ সত্যিকারের আধুনিক বাহিনীতে পরিণত হতে পারে। অনেক উন্নত দেশে যেমন পুলিশিংয়ের মূল ভিত্তি “community trust”—বাংলাদেশেও সেটা গড়ে তোলা সম্ভব, যদি বাহিনী নিজেদের জনগণের সেবক হিসেবে দেখতে শেখে।
বাহারুল আলমের সাফল্য শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে তাঁর সংস্কারচেষ্টার আন্তরিকতার ওপর। তিনি যদি রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে নিজের পেশাদার অবস্থান ধরে রাখতে পারেন, তবে এই বাহিনীর ভাবমূর্তি ধীরে হলেও পাল্টাবে। কিন্তু যদি আগের মতোই দলীয় আনুগত্য, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও ক্ষমতার লেনদেনের চক্র বজায় থাকে, তাহলে এই পরিবর্তন কেবল পদবদলেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বাংলাদেশের পুলিশ ইতিহাসে এমন মুহূর্ত আগে বহুবার এসেছে—যখন নতুন নেতৃত্বের হাতে পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু প্রতিবারই সেই প্রত্যাশা ভেঙেছে রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষে। বাহারুল আলম হয়তো সেই ধারাবাহিকতা ভাঙার সুযোগ পাচ্ছেন, তবে এর জন্য তাঁকে শুধু একজন প্রশাসক নয়, একজন নৈতিক নেতৃত্বে পরিণত হতে হবে।
কারণ এই দেশের মানুষ এখন কেবল নিরাপত্তা চায় না—তারা ন্যায়বিচার, সমান আচরণ, এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ফিরে পেতে চায়। সেই আস্থার পুনর্গঠন পুলিশের দায়িত্বের অংশ, আর এই দায়িত্ব পূরণই হবে নতুন আইজিপির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
আপনার মতামত জানানঃ