ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক, ভূরাজনৈতিক ও জলসম্পদসংক্রান্ত উত্তেজনা নতুন এক বাঁক নিচ্ছে সিন্ধু পানি চুক্তি (Indus Waters Treaty – IWT) নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কারণে। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই ঐতিহাসিক চুক্তিটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার একমাত্র কার্যকর ও প্রতিষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় জলসম্পদ শাসন কাঠামো। তবে ভারত যখন এই চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিল, তখন তা শুধু একটি কূটনৈতিক সংকেতই নয়—সম্ভাব্য সংঘাতের একটি ঘন মেঘও।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির সাম্প্রতিক বক্তব্যে এই উদ্বেগ যেন আরও ঘনীভূত হলো। পাকিস্তান পার্লামেন্টে দেওয়া এক ভাষণে তিনি সরাসরি বলেন, যদি ভারত সিন্ধু অববাহিকার পানি বন্ধ করে পাকিস্তানকে তার ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে দেশটি যুদ্ধে যেতে বাধ্য হবে। যদিও এটি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি শক্তিশালী বার্তা, তবে এ বক্তব্যের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, আন্তর্জাতিক আইন, এবং বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা—যা যুদ্ধের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য।
সিন্ধু পানি চুক্তি মূলত সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে। এই চুক্তি অনুযায়ী, তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী—বেয়াস, রবি ও সাতলজ—ভারতের দখলে এবং তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী—সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব—পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। প্রায় ছয় দশক ধরে এই চুক্তি কার্যকর ছিল, এমনকি দুই দেশের মাঝে যুদ্ধকালেও। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে, পানি নিয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একে কূটনৈতিকভাবে সমাধান করা সম্ভব।
তবে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে একটি সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত সরকার সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয়। এরপর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সরাসরি বলেন, এই চুক্তি ‘আর কখনও পুনরুদ্ধার করা হবে না’। এ বক্তব্য কেবল রাজনৈতিক রণনীতি নয়, বরং পাকিস্তানকে পানি কূটনীতির মাধ্যমে চাপে ফেলার একটি কৌশল হিসেবেও দেখা যায়।
এই প্রেক্ষাপটে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির বক্তব্য ছিল দ্ব্যর্থহীন। তিনি বলেন, ভারতের দুটি পথ রয়েছে—পানি ন্যায্যভাবে ভাগ করা অথবা পাকিস্তানকে ছয়টি নদীর পানি পুনরুদ্ধার করতে দেওয়া। তিনি ভারতের ‘চুক্তি শেষ’ ঘোষণাকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেন।
এখানে লক্ষ্যণীয়, ভুট্টো যুদ্ধের হুমকি দিলেও একইসাথে আলোচনার আহ্বানও জানান। তিনি বলেন, আলোচনা না হলে সহিংসতা আরও বাড়বে এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ব্যাপক আকার ধারণ করবে। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করার জন্য এফএটিএফ (FATF) এবং কাশ্মীর ইস্যুতে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছে।
এ পর্যায়ে প্রশ্ন আসে—এই উত্তেজনা কি সত্যিই যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে?
সিন্ধু পানি চুক্তি বিশ্বব্যাংক পরিবীক্ষণ করে থাকে, এবং এটি একটি আন্তর্জাতিক আইনানুগ কাঠামোর অধীনে পরিচালিত। চুক্তির একতরফা বাতিল আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। যদি ভারত সত্যিই সম্পূর্ণরূপে পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসংঘে পাকিস্তান আইনি লড়াইয়ে যেতে পারে, যা যুদ্ধের আগেই একটা ভারসাম্য তৈরি করতে বাধ্য করবে।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পরমাণু শক্তিধর দেশ। তাই যুদ্ধ মানেই হবে দুই দেশের জন্য আত্মবিনাশ। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পরও এই বাস্তবতা দুই দেশকে পুনঃপুনঃ সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেও পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ এড়াতে বাধ্য করেছে।
বর্তমান বিশ্বে দুই দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা এমন নয় যে, তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালাতে পারে। পাকিস্তানের অর্থনীতি IMF ও চীনা ঋণের ওপর নির্ভরশীল এবং ভারতের সাম্প্রতিক বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করবে।
ভারতে ২০২৬ সালে সাধারণ নির্বাচন আসছে। বিজেপি সরকার জাতীয়তাবাদী আবেগকে উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে, তবে এর জন্য প্রকৃত যুদ্ধ নয়, বরং সীমান্তে ক্ষুদ্র উত্তেজনা সৃষ্টি করাই বেশি কার্যকরী হতে পারে।
দুই দেশেই পানির ঘাটতি ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয়ের হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে, যার ফলে পানির প্রবাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। এই সংকটকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে পানি যুদ্ধ নতুন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তবে তা এই মুহূর্তে সরাসরি যুদ্ধ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কষাঘাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিলাওয়াল ভুট্টোর বক্তব্যকে আমরা একধরনের ‘জল কূটনীতির হুঁশিয়ারি’ হিসেবে দেখতে পারি। এটি যুদ্ধের সরাসরি আহ্বান নয়, বরং ভারতকে চাপ দেওয়ার কৌশল। তবে ভারত যদি সত্যিই সিন্ধু নদীর পানির প্রবাহে স্থায়ীভাবে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে পাকিস্তান একে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে গণ্য করবে, যা পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
তবে বাস্তবতা হলো, যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনও সীমিত, কারণ আন্তর্জাতিক কূটনীতি, পরমাণু ভারসাম্য, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং জলসম্পদের ওপর বৈশ্বিক নির্ভরশীলতা উভয় দেশকেই যুদ্ধে না গিয়ে আলোচনার পথ বেছে নিতে বাধ্য করবে। তবুও পানি যদি অস্ত্র হয়ে ওঠে, তবে উপমহাদেশে আগুন জ্বলার আশঙ্কা অমূলক নয়।
আপনার মতামত জানানঃ