যুগে যুগে মানুষ স্বপ্ন দেখেছে পরশ পাথর তৈরি করতে। লোহা বা সীসাকে স্বর্ণে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন অনেক বিজ্ঞানীরাও। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের আলকেমিস্টরা সেই স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আধুনিক যুগের কয়েকজন বিজ্ঞানীও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আইজ্যাক নিউটন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর জীবনের অনেকটা বছর কাটিয়েছেন শুধু পরশ পাথরের খোঁজে। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে এটা অবাস্তব বলেই মনে হতে পারে। কারণ সীসা আর স্বর্ণ—দুটোই আলাদা মৌলিক পদার্থ। শুধু রাসায়নিক বিক্রিয়া দিয়ে একটাকে আরেকটায় রূপান্তর করা যায় না।
তবে পারমাণবিক স্তরে গেলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সীসা আর স্বর্ণের মধ্যে আসল পার্থক্যটা খুবই নির্দিষ্ট। সীসার পরমাণুর চেয়ে স্বর্ণের পরমাণুতে মাত্র তিনটি অতিরিক্ত প্রোটন থাকে। তাহলে কি তিনটি প্রোটন বেরিয়ে গেলেই সীসা স্বর্ণে রূপান্তর হবে?
বিজ্ঞানের হিসেবে সেটা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে? খুব কঠিন কাজ। আর এই কঠিন কাজটাই হঠাৎ করে ফেলেছেন সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের পদার্থবিজ্ঞানীরা। তবে ইচ্ছে করে নয়, দুর্ঘটনাবশত!
আধুনিক যুগের কয়েকজন বিজ্ঞানীও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আইজ্যাক নিউটন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর জীবনের অনেকটা বছর কাটিয়েছেন শুধু পরশ পাথরের খোঁজে।
লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে অ্যালিস নামে একটি পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা সীসার পরমাণু একে অপরের দিকে তীব্র গতিতে ছুঁড়ে মারেন। উদ্দেশ্য ছিল বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরের অবস্থার একটা প্রতিরূপ তৈরি করা।
এই সংঘর্ষে সবসময় সরাসরি ধাক্কা লাগে না। বেশিরভাগ সময় সীসার পরমাণুগুলো খুব কাছ দিয়ে চলে যায়। একে বলে নিয়ার-মিস বা প্রায় সংঘর্ষ হওয়া। এমন পরিস্থিতিতে কণাগুলো একে অপরের প্রতি প্রবল বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল প্রয়োগ করে। প্রায় সংঘর্ষের সময় প্রচণ্ড বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের প্রভাবে কোনো পরমাণুর প্রোটন বেরিয়ে যেতে পারে। আর ঠিক তিনটি প্রোটন বেরিয়ে গেলেই সীসার পরমাণু বদলে যাবে স্বর্ণে!
অ্যালিস পরীক্ষার সময় বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৮৯ হাজার স্বর্ণের পরমাণু তৈরি হচ্ছে! সঙ্গে তৈরি হচ্ছে থ্যালিয়াম আর পারদ। সীসা থেকে একটা পরমাণু কমলে তৈরি হয় থ্যালিয়াম, আর দুটি কমলে পারদ।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা কীভাবে বুঝলেন যে এটা সত্যিই স্বর্ণ তৈরি হয়েছে? এখানে একটা সমস্যা হলো, এই স্বর্ণের পরমাণুগুলো সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। কারণ সেগুলো খুব দ্রুত কলাইডারের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা একে চিহ্নিত করেন পরোক্ষভাবে। তারা ব্যবহার করেন জিরো-ডিগ্রি ক্যালরিমিটার নামে একধরনের বিশেষ যন্ত্র। এই যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়, কয়টি প্রোটন সীসার পরমাণু থেকে ছিটকে পড়েছে। তিনটি প্রোটন হারানো মানেই সেটা স্বর্ণ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতে কি লাভ হচ্ছে নাকি ক্ষতি? শুনে মনে হতে পারে, সত্যি যদি স্বর্ণ তৈরি হয়, তাহলে তো বিশাল সাফল্য! কিন্তু বাস্তবতা একটু আলাদা। যে মুহূর্তে সীসার পরমাণু তার আসল গঠন হারায়, মানে প্রোটন হারিয়ে ফেলে, তখন সেটা আর কলাইডারের মধ্যে স্থিতিশীলভাবে ঘুরতে পারে না। কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যেই সেটা কলাইডারের দেওয়ালে ধাক্কা খায়। ফলে কণার প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এই অনিচ্ছাকৃত স্বর্ণ উৎপাদন একরকম ঝামেলাই।
আলকেমিস্টদের হাজার বছরের স্বপ্ন অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও বিজ্ঞানীরা সফল করেছেন। যদিও তা খুব সামান্য, কিন্তু সম্ভব তো হয়েছে! এতই সামান্য যে এই স্বর্ণ দিয়ে গহনা তো দূরের কথা, ধূলিকণাও তৈরি করা যাবে না।
কিন্তু তবুও এটা নিয়ে এত কৌতূহল কেন? আসলে এটা শুধু একটা দুঃখজনক দুর্ঘটনা নয়, বরং এই অজান্তেই পাওয়া ফলাফলগুলো ভবিষ্যতের বড় বড় পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কীভাবে প্রোটন বেরিয়ে আসে, কোন পরিস্থিতিতে বেরোয় এবং কোন মৌল তৈরি হয়, এসব বুঝতে পারলে আরও সূক্ষ্ম ও নিখুঁত গবেষণা করা সম্ভব হবে।
তবে একটা কথা বলাই যায়, আলকেমিস্টদের হাজার বছরের স্বপ্ন অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও বিজ্ঞানীরা সফল করেছেন। যদিও তা খুব সামান্য, কিন্তু সম্ভব তো হয়েছে! এতই সামান্য যে এই স্বর্ণ দিয়ে গহনা তো দূরের কথা, ধূলিকণাও তৈরি করা যাবে না।
তবে, যুগে যুগে যা অলৌকিক বলে ধরা হতো, তা-ই আজ বিজ্ঞানের অনিচ্ছাকৃত খেলায় বাস্তব হয়ে উঠেছে। পরশ পাথর হয়তো নেই, কিন্তু পারমাণবিক শক্তি দিয়ে আজ মানুষ প্রকৃতির মৌলিক নিয়মকেও অল্প সময়ের জন্য হলেও বদলে দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ