নির্বাচন নিয়ে একটা গ্যাঞ্জাম বেধে গেছে। ঘুরেফিরে একটা বিষয়কে কেন্দ্র করেই চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে—সংস্কার না নির্বাচন, কোনটা আগে। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘ঐকমত্যের কমিশন’-এর রিপোর্ট সব দলের কাছে পাঠানো হয়েছে। এর ভিত্তিতে হবে সংলাপ। তারপর অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সংস্কার করবে, বাকিটা করবে নির্বাচিত সরকার। তবে দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে ক্ষমতায় গেলে তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। কয়েকটি দল, বিশেষ করে বিএনপি এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। তারা সরকারকে বারবার সতর্ক করে দিচ্ছে, শিগগিরই নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে।
এ যেন অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে—এ নিয়ে তর্ক। সরকারের ভেতরে থেকে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু পত্রিকা পড়লে আর ফেসবুক ঘাঁটলে মনে হয়, দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এখানে–সেখানে আন্দোলন, ঝগড়া, উসকানি, গালাগালি, মারামারি—কোনোটাই কমতির দিকে নেই, বরং বাড়ছে দিন দিন। এর মধ্যে আরেকটি বিষয় ঢুকে গেছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (জানাপ) নেতারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। এ অবস্থায় নির্বাচন হতে পারে না। এর ফলে জানাপ অনেকটাই বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। ইফতার পার্টিতে পাশাপাশি বসে হেসে হেসে পেঁয়াজু-বেগুনি খেলেও বোঝা যায়, সামনে ঝড় আসবে।
আইনশৃঙ্খলার জন্য আছে পুলিশ বাহিনী। আগস্ট অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছিল। এখনো তারা আছে। তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের মতোই সেনাবাহিনীর সদস্যরা কিছু অ্যাকশন নিতে পারেন। সেনানেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেনারা যেন সমঝে চলেন। পাবলিক ডিলিং বড় বেশি ঝামেলার। শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে অনেক সময় পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যায়। সেনাবাহিনী সে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। যারা পাবলিকের ওপর পুলিশের দাবড়ানি দেখে অভ্যস্ত, তারা বলছে, মিলিটারিরা এত নিষ্ক্রিয় কেন? অ্যাকশনে যায় না কেন?
আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই পুলিশ নিষ্ক্রিয়। কারণগুলো আমরা মোটামুটি জানি। প্রথমত, ওই সময় পুলিশের আচরণ ছিল খুব নির্দয়। যাদের ধমক দিয়ে, লাঠিপেটা করে কিংবা গ্রেপ্তার করেই সামাল দেওয়া যায়, তাদের পয়েন্ট ব্ল্যাংক গুলি করে মেরে ফেলতে দেখা গেছে। ফলে ছাত্র-জনতা আরও ক্ষুব্ধ হয়েছে। পুলিশের ওপর তাদের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে।
দ্বিতীয়ত, অভ্যুত্থানের পর বিক্ষুব্ধ জনতা অনেক জায়গায় থানায় হামলা করেছে, আগুন দিয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এটা স্বাভাবিক, পুলিশ অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গেছে। তাদের মনোবলের ওপর আঘাত এসেছে। তারা আর আগের মতো অ্যাকশনে যেতে পারছে না। এটা সত্য যে পুলিশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। তারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় সরকার দ্বারা। এর মধ্যেও যেসব পুলিশ সদস্য বাড়াবাড়ি করেন, তাঁরা সরকারকে খুশি রাখার জন্যই অনেক অকাজ-কুকাজ করেন। কাউকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার যে প্রবচন চালু আছে, তার উৎপত্তি সম্ভবত এখান থেকেই।
তৃতীয়ত, আগস্ট অভ্যুত্থানের পর পুলিশে অনেক রদবদল হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ছন্দে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। সেনাপ্রধান এটা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, তাঁরা পুলিশের বিকল্প নন। ৩০ হাজার সেনাসদস্য মাঠে নামিয়ে দুই লাখ পুলিশ সদস্যের কাজ করানো সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, পুলিশ তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পুরোপুরি পালনের সক্ষমতা অর্জন করতে কত সময় নেবে। এ মুহূর্তে এটা বলা মুশকিল।
সম্প্রতি ধর্ষণবিরোধী একটি মিছিল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। মিছিলকারীরা ভালোই জানেন, ওখানে মিছিল করে যাওয়া যাবে না। পুলিশের চাকরি হলো তাঁদের একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে আটকে দেওয়া। তো সেখানে হাতাহাতি-মারামারি হলো। প্রথমে ছবি দেখে মনে হলো, এ তো স্বৈরাচারের পুলিশ! পরে পুরো ভিডিও দেখে মনে হলো, সব দায় পুলিশের কাঁধে চাপানো কি ঠিক হবে?
এক পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা গেল, এক নারীর চুলের মুঠি ধরে টানছেন। ভয়াবহ ব্যাপার! দেখলাম, তিনিই প্রথমে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমার সেই দৃশ্যটার কথা মনে আছে, যেখানে সংসদ ভবন চত্বরে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে এক পুলিশ কর্মকর্তা পিটিয়েছিলেন। তার আগে ফারুক সাহেব
তাঁকে গালাগাল করেছিলেন। সংসদ সদস্যের হাতে সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, এমনকি দলীয় কর্মীদের মার খাওয়ার সংবাদ ও ভিডিও আমরা প্রায়ই দেখি। এসব দেখেই লোকে ধরে নেয়, রাজনীতিতে ভদ্রলোকের জায়গা নেই। সেখানে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ হতে হয়। সোজা কথায়—মাস্তানি।
আক্রান্ত হলে বা গালাগাল শুনলে অনেক সময় পুলিশের মাথা ঠিক থাকে না। তবে যেহেতু পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ আছে, ‘ক্রাউড’-এর মতো আচরণ তাঁদের কাছ থেকে কাম্য নয়। ট্রেনিং ম্যানুয়ালে নিশ্চয়ই কোনো নারীর চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা নেই। মাথা ঠান্ডা রেখেই তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি বেতন পান দায়িত্ব পালনের জন্য, মাস্তানির জন্য নয়। এ জন্য দরকার রুচি, শিক্ষা ও সংবেদনশীলতা। পারিবারিক শিক্ষা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে এটা সব সময় মনে রাখা দরকার। যারা শৈশবে সুস্থ পরিবেশ পায়নি, বাবাকে দেখেছে মাকে অশ্রাব্য গালি দিতে আর পেটাতে, তার অবচেতন মনে ওই সবের শিকড় গেঁথে যায়। সে-ও নারী দেখলে খিস্তি করে, তার ওপর চড়াও হয়। ফেসবুকে এদের ছড়াছড়ি। এখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।
নির্বাচন এলেই আমরা একটা অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যাই। দিনরাত মিটিং–মিছিল–স্লোগান। জনসেবকেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি-লাঠালাঠি করেন। অনেক আগে এক বিএনপি নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের মুখে একটা কথা শুনেছিলাম, নির্বাচন মানে পাঁচটা চোরের মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়া। আমরা দেখেছি, চিহ্নিত চোর আর সন্ত্রাসীরাই দলের মনোনয়ন পায়। দলগুলো তাদের পুরোনো মুখগুলোকেই কুমিরছানার মতো বারবার ফিরিয়ে আনে।
তারপর চলে টাকার খেলা আর পেশির আস্ফালন। আশা করি, এবার আমরা এসব থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। আমার একটা কষ্টকল্পিত আশা আছে, তাঁরা অতীত দেখে পরিষ্কার ভাবমূর্তির লোকেদের প্রার্থী করবেন। না হলে অবস্থা থেকে যাবে আগের মতোই—‘ফ্রম বার্নিং ওভেন টু ফ্রাইং প্যান’, জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াই। নির্বাচন এলেই এ রকম আশঙ্কা মনের মধ্যে উঁকি দেয়।
যে কথা বলছিলাম, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে জোর গলায় কিছু বলা যাচ্ছে না। একটা ন্যূনতম পরিবেশ লাগবে নির্বাচনের জন্য, যেখানে নারী-পুরুষনির্বিশেষে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। জানাপ নেতা হয়তো এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এ কথার মধ্যে কেউ কেউ ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে পারেন। তাঁদের আশঙ্কা, নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে যেতে পারে।
গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে নির্বাচনের বিকল্প নেই। আমরা এ মুহূর্তে কেউ চীনের মতো একটা রেজিমেন্টেড সরকারব্যবস্থার কথা ভাবছি না। আমরা বলছি বহুদলীয় সংসদীয় সরকারব্যবস্থার কথা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতিযোগী হবে। আমরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক, যারা আমাদের বিরুদ্ধে তারা সবাই দেশের শত্রু ও ষড়যন্ত্রকারী, আমাদের দলকে জিততেই হবে, আমরা না জিতলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে—এ রকম চিন্তাভাবনা যত দিন থাকবে, তত দিন দেশে গণতন্ত্র আসবে না এবং নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে না।
যাঁরা আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসবেন, তাঁদের অনেকেই তাঁদের পরিবারকে বিদেশে রেখে দিয়েছেন। বাংলাদেশের ওপর তাঁদের আস্থা নেই। এটা তাঁদের সেকেন্ড হোম। নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলগুলোকে এদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। সবাই মিলে এ রকম একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা দরকার। এখন যে অবস্থা চলছে, সেটি কাম্য নয়, আমরা স্থিতি চাই। অস্থির সমাজে কোনো বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। অনেকের মতো আমিও মনে করি, আমাদের সামনে আবার একটা সুযোগ এসেছে। আমরা যেন সুযোগসন্ধানীদের ফাঁদে পড়ে সে সুযোগ না হারাই।
আপনার মতামত জানানঃ