ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক ও বর্তমান পরিচালক, যন্ত্রপাতি কেনা ও গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্ট কমিটির বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসপাতালের জন্য বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম পেয়েছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি। আলোচিত পর্দা কাণ্ডে আর্থিক অনিয়ম, যন্ত্রপাতি কেনার অনিয়মের পাশাপশি যন্ত্রপাতি ফেলে রেখে ‘নষ্ট করার প্রবণতা’ খুঁজে পেয়েছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে সংসদীয় উপ-কমিটি বলেছে, মালামাল ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, কেনা মালামালের দাম বাজার মূল্যের ব্যবধান অত্যধিক, মালামাল কেনার পর যথাযথভাবে ব্যবহার না করে ফেলে রেখে নষ্ট করার প্রবণতা দেখা গেছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
হাসপাতালটির কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর একটি উপকমিটি (তদন্ত কমিটি) গঠন করেছিল স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। গতকাল রোববার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নিজেদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনে উপ-কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশে বলেছে, রেসপনসিভ দরদাতার জায়গায় নন-রেসপনসিভ দরদাতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কার্যাদেশ দেওয়ায় সরকারের কোটি কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। পর্দা, অক্সিজেন জেনারেশন মেশিন, লিনার অক্সিলেটর মেশিন কেনায় সরকারি নিয়ম (পিপিআর) অনুসরণ করা হয়নি। যন্ত্রপাতি পরীক্ষা না করে গ্রহণ করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি কেনা ও গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্ট কমিটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাবেক ও বর্তমান পরিচালক, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, কারিগরি কমিটি, যন্ত্রপাতি গ্রহণ কমিটির প্রতিনিধিদের বক্তব্যে অস্পষ্টতা ও অসামঞ্জস্য রয়েছে। মালামাল ক্রয়প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে যন্ত্রপাতি কেনা এবং মালামাল কেনার পর তা যথাযথভাবে ব্যবহার না করে ফেলে রেখে নষ্ট করার প্রবণতা দেখা গেছে।
কমিটি বাংলাদেশের সব হাসপাতালের যন্ত্রপাতি গুণগতমান বজায় রেখে সংগ্রহ করা হচ্ছে কিনা এবং যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়কে একটি মনিটরিং টিম গঠন করতে বলেছে।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি একটি উপ-কমিটি গঠন করে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিককে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের কমিটির গঠন করা হয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কমিটির চতুর্থ বৈঠক হয় ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে। এর আগের তিন বৈঠকে এ সম্পর্কিত সব নথি পরীক্ষা ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া এবং সরেজমিন পরিদর্শন করে উপ-কমিটি।। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সংসদীয় কমিটির কোনও বৈঠক না হওয়ায় উপ-কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিতে পারেনি। গতকাল রবিবার (২৪ জানুয়ারি) এই প্রতিবেদন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জমা দেওয়া হয়।
উপ-কমিটির আহ্বায়ক মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ‘তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কমিটির আগামী বৈঠকে প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হবে।
সূত্র জানায়, ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পাঁচজন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। শুরুতে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন আ স ম জাহাঙ্গীর। তিনি জানান, তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কিছু কেনাকাটা হয়েছে। সেখানে কিছু অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। যে কয়টি ‘আইটেম’ কেনা হয়েছিল, তার মধ্যে তিনটি বেশি দামে কেনা হয়েছিল। সেগুলো পরবর্তীকালে সংশোধিত বাজেটে পাস হয়েছে। এটুকুই তিনি জানেন।
২০১৯ সালে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পর্দা ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে আসে। এক পর্দার দাম ৩৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছে বলে ওই বছর সেপ্টেম্বরে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। পর্দা ও যন্ত্রপাতি কেনায় ১০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুদক ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মামলা করে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ওই মামলা হয় ছয় জনের বিরুদ্ধে। তাছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের সাবেক দুই প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আসম জাহাঙ্গীর চৌধুরী ও ডা. গণপতি বিশ্বাসকে চাকরি হতে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে সরকার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেরিতে হলেও সংসদীয় কমিটি এই দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করল, এটি ইতিবাচক। এই দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। সংসদীয় কমিটির তদন্তেও বিষয়গুলো উঠে আসায় এর সংসদীয় রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। যারা রেসপনসিভ নয়, তারা শুরুতেই বাদ পড়ার কথা। অথচ তারা কাজ পেয়েছে। তার মানে এখানে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। ঠিকাদার এবং সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা–কর্মচারীর বিরুদ্ধে দ্রুত বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এই তদন্ত দুদকের মামলায়ও সহায়ক হবে বলে জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ