এমনও জল্পনা শোনা যায় যে, অপ্রত্যাশিত সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হতে পারেন নেতানিয়াহু।
‘ইসরায়েল এক্সপ্লেইনড’ এবং ‘হিস্টরি অব দ্য ল্যান্ড অব ইসরায়েল’ পডকাস্টের উপস্থাপক ও বিশ্লেষক শায়েল বেন-এফ্রাহিম বলেন, যুদ্ধ যুদ্ধ দেখে মনে হচ্ছে সফলতা কম হবে। সব কিছু দূরে সরে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি মনে করি না যে, অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু টেলিগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপে সামরিক লোকজন বলাবলি করছেন, নেতানিয়াহুকে সরিয়ে দেয়া উচিত। বেন গাভিরের মতো কারও কিছু করা উচিত। এটা খুবই উদ্বেগের। বাম এবং মধ্যপন্থিদের কথা আমরা নিয়মিত অনেকদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু এখন শাবাকের (ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এজেন্সি) ভেতরের লোকজনই এটা নিয়ে আলোচনা করছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক বিষয়ক ইসরায়েলি আইনজীবী এবং টিরেসট্রিয়াল জেরুজালেম নামের এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা ডানিয়েল সেইডেমান বলেন, নেতানিয়াহু আমাদেরকে এমন পথে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে বিদ্রোহ কখনোই শেষ হবে না। পুরো সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট এর বিরোধিতা করছে। সরকারের ভেতরে বর্ণবাদী নয় বা হিংসুটে নয় এমন বিশ্বাসযোগ্য মানুষও এর বিরোধিতা করছে। কিন্তু নেতানিয়াহু গোঁ ধরেছেন
নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচানোর জন্যই গাজায় যুদ্ধ করছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এমনকি এ জন্যই তিনি বিশ্বনেতাদের মতামত, জাতিসংঘকে তুচ্ছ করছেন। জাতিসংঘ হলো বিশ্ব সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। এর সর্বোচ্চ আদালতের রায়কেও উপেক্ষা করছেন তিনি। জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের রায়কে তাই অন্যায্য, মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়েছে- এমন মন্তব্য দেখানো সাহস পাচ্ছেন নেতানিয়াহু। তিনি এ সাহস পাচ্ছেন শুধু যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা অল্প কিছু দেশের অস্পষ্ট সমর্থনের কারণে।
নিজের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদে কোন্দল দেখা দিয়েছে। দেশের ভেতর থেকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানো হচ্ছে। প্রায় সপ্তাহে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে যেতে রাজি নন। তিনি হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করতে চান। আসলেই কি তিনি হামাসকে নির্মূল করছেন, নাকি বৃহৎ একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জাতিনিধনের মতো হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছেন!
তিনি যে কমপক্ষে ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছেন, তার মধ্যে হামাস সদস্য কতোজন? এ প্রশ্ন করলে নেতানিয়াহু উত্তর দিতে পারবেন? পারবেন না। কারণ, তিনি ভালোভাবেই জানেন হামাস নিশ্চিহ্ন করার নামে তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ছোট্ট ছোট্ট শিশু ও নারীদের হত্যা করছেন। বাকি জনগোষ্ঠীকে খাবার, পানি, ওষুধ, হাসপাতাল বন্ধ ও ধ্বংস করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। এর মধ্যদিয়ে তিনি বুক ফুলিয়ে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনলাইন আরব নিউজে জোনাথন গোরন্যাল এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, গত বুধবার সন্ধ্যায় গাজার উত্তরে এক ঘটনায় ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারে’ ইসরায়েলের পাঁচ সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে সাতজন। নিহত ৫ প্যারাট্রুপারের বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। টাইমস অব ইসরায়েলের মতে, তারা ছিল উগ্র অর্থোডক্স একটি কোম্পানির প্যারাট্রুপার। জাবালিয়ায় যুদ্ধের সময় নিজেদের সেনার গুলিতে তারা নিহত হয়েছে। নিজেদের কমরেডদের হাতে নিজেদের সেনা নিহতের ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) মতে, গত বছর ২৭শে অক্টোবর গাজায় স্থল হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তখন থেকে তাদের ২৭৯ সেনা নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯ জন নিহত হয়েছে ফ্রেন্ডলি ফায়ারে বা কোনো দুর্ঘটনায়। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর সাত মাস পরেও ইসরায়েলি সেনাদেরকে গাজায় যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সেখানে মরতে হচ্ছে। এর ফলে ইসরায়েলের ভেতরে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি করা এড়িয়ে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু। এতে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, গাজা যুদ্ধকে অব্যাহত রাখার একটি কৌশল নিয়েছেন নেতানিয়াহু, যাতে তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে রক্ষা করতে পারেন।
কৌশল নির্ধারণের পর তা পরিবর্তনের জন্য নেতানিয়াহুর ওপর সেনাবাহিনী সম্প্রতি চাপ সৃষ্টি করেছে। এটা কোনো গোপন খবর নয়। গত বুধবার জাবালিয়ায় সেনা নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে র্যাংক ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন ইয়োভ গ্যালান্ট। ব্যতিক্রমী এক ভিডিও বার্তায় সাবেক এই জেনারেল প্রকাশ করেছেন যে, গাজা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তিনি মন্ত্রিপরিষদের মিটিংগুলোতে নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অবশ্যই সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে। হামাসের পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনের গাজা কে নিয়ন্ত্রণ করবে তা নির্ধারণ করতে হবে আন্তর্জাতিক সঙ্গীদের সঙ্গে। তার মধ্যদিয়ে গাজায় হামাসের বিকল্প শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ্যালান্ট বলেন, দুর্ভাগ্য হলো এই ইস্যুটি বিতর্কের জন্য তোলাই হয়নি। আরও খারাপ বিষয় হলো এর বিকল্প কোনো বিষয় আনাও হয়নি। এরপরই নেতানিয়াহুকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সমালোচনা করে বসেন। তিনি বলেন, সেখানে সিদ্ধান্তহীনতাই হলো সিদ্ধান্ত। এর ফলে বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে সব। এই ধারণা এটাই বলে যে, গাজায় হবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক সরকার।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য এটি একটি নেতিবাচক ও বিপজ্জনক অপশন। বিশেষ করে কৌশলগত, সামরিক এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে। সংক্ষেপে তিনি বলেন, গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আমি রাজি হবো না। এরপরই ইয়োভ গ্যালান্ট সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। বলেন- আমি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অনুরোধ করবো একটি সিদ্ধান্ত নিতে এবং ঘোষণা দিতে যে, গাজা উপত্যকায় বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে না ইসরায়েল। গাজা উপত্যকায় সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করবে না ইসরায়েল। পক্ষান্তরে হামাসের বিকল্প একটি প্রশাসন অবিলম্বে গড়ে তোলা হবে।
এই আক্রমণ করে বক্তব্যের তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জবাব দেননি নেতানিয়াহু। কিন্তু উগ্র ডানপন্থি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গালি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন ইয়োভ গ্যালান্টকে বরখাস্ত করতে। এখানে উল্লেখ্য, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে জোট গঠন করে ক্ষমতায় আছেন, তার দুর্বল একটি অংশ হলেন ইতামার বেন গাভির। তিনি বার বার গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বের করে দিয়ে সেখানে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। যেহেতু তিনি নেতানিয়াহুর দুর্বল জোটের সঙ্গী, ফলে তার দাবির মূল্য আছে নেতানিয়াহুর কাছে।
এর মধ্যদিয়ে নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদে টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। কারণ, গত শনিবার যুদ্ধকালীন তিন সদস্যের মন্ত্রিপরিষদের আরেক সদস্য এবং নেতানিয়াহুর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেনি গান্টজ ঘোষণা দিয়েছেন, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে জয়ের পরে তার ৬ দফার সঙ্গে যদি আগামী ৮ই জুনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সম্মত না হন তাহলে ইসরায়েলে জরুরি জোট থেকে তিনি এবং তার মধ্যপন্থি ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি বেরিয়ে যাবেন। যদি এমন হয় তাহলে বড় চাপে পড়বেন নেতানিয়াহু।
বেনি গান্টজের পরিকল্পনার মধ্যে আছে- জিম্মিদের ফেরা নিশ্চিত করা। হামাসের শাসন খতম করে দেয়া। গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ করা। আমেরিকা, ইউরোপিয়ান, আরব এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক প্রশাসন গঠন করা। এরা সেখানে বেসামরিক বিষয় দেখাশোনা করবে। বেনি গান্টজ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেছেন, ক্ষুদ্র একটি সংখ্যালঘুরা ইসরায়েল নামের জাহাজের ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তারা এটাকে এক কণ্টকিত পথে ধাবিত করছে। দীর্ঘস্থায়ী এবং কঠোর একটি যুদ্ধ এড়াতে হলে এখনই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইসরায়েলের নেতৃত্ব এখন দ্বিধাবিভক্ত। জনগণ ক্রমশ গাজা এবং ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি এমনও জল্পনা শোনা যায় যে, অপ্রত্যাশিত সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হতে পারেন নেতানিয়াহু। ‘ইসরায়েল এক্সপ্লেইনড’ এবং ‘হিস্টরি অব দ্য ল্যান্ড অব ইসরায়েল’ পডকাস্টের উপস্থাপক ও বিশ্লেষক শায়েল বেন-এফ্রাহিম বলেন, যুদ্ধ যুদ্ধ দেখে মনে হচ্ছে সফলতা কম হবে। সব কিছু দূরে সরে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান নিয়ে কথা হচ্ছে। আমি মনে করি না যে, অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু টেলিগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপে সামরিক লোকজন বলাবলি করছেন, নেতানিয়াহুকে সরিয়ে দেয়া উচিত। বেন গাভিরের মতো কারও কিছু করা উচিত। এটা খুবই উদ্বেগের। বাম এবং মধ্যপন্থিদের কথা আমরা নিয়মিত অনেকদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু এখন শাবাকের (ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এজেন্সি) ভেতরের লোকজনই এটা নিয়ে আলোচনা করছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক বিষয়ক ইসরায়েলি আইনজীবী এবং টিরেসট্রিয়াল জেরুজালেম নামের এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা ডানিয়েল বলেন, নেতানিয়াহু আমাদেরকে এমন পথে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে বিদ্রোহ কখনোই শেষ হবে না। পুরো সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট এর বিরোধিতা করছে। সরকারের ভেতরে বর্ণবাদী নয় বা হিংসুটে নয় এমন বিশ্বাসযোগ্য মানুষও এর বিরোধিতা করছে। কিন্তু নেতানিয়াহু গোঁ ধরেছেন। এর পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। তা হলো- ১. স্বভাবতই সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম নেতানিয়াহু। তিনি সবসময় গড়িমসি করেন। ২. শান্তি বজায় থাকুক তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি সব সময় চান নিজেকে শক্তিশালী দেখাতে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে পুঁজি করে নেতানিয়াহু নিজের স্বার্থকে রক্ষা করছেন। ৩. যুদ্ধের শেষ, একটি যুদ্ধবিরতির ফলে নেতানিয়াহুর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। সম্ভবত তাকে জেলেও পাঠানো হতে পারে। এক্ষেত্রে ফুলস্টপ পড়তে পারে। এ জন্য তিনি জিম্মি ও তাদের পরিবারকে জিইয়ে রাখছেন।
নেতানিয়াহু জানেন যে, যদি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে তার মূল্য হিসেবে তাকে যুদ্ধবিরতি করতে হবে। যুদ্ধবিরতি করা হলে তা তাকে শেষ করে দেবে। তাই তিনি এই যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখতে সম্ভাব্য সবকিছু করছেন। ইসরায়েলের বেশির ভাগ মানুষ এখন এভাবেই কথা বলছেন। তারা বলছেন, নেতানিয়াহুর সব কর্মকাণ্ড, বিবেচনার সবটাই হলো তার ব্যক্তিগত। একই রকম কথা বলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিজ-এর এডজাংক্ট ফেলো সেঠ ফ্রানজম্যান।
আপনার মতামত জানানঃ