পাখির বিবর্তন সম্পর্কে এতদিন ধরে যে প্রচলিত ধারণা, তা আসলে ভুল ছিল, এমনই উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
এপ্রিলের ১ তারিখে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীদের দাবি, সাড়ে ছয় কোটি বছর আগের এক ঘটনা পাখিদের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে তাদের বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেছিল।
তাদের অনুসন্ধান বলছে, পাখির ক্রোমোজোমের একটি অংশ লাখ লাখ বছর ধরে হিমায়িত অবস্থায় ছিল, যা এর কাছাকাছি থাকা কোনও ডিএনএর সঙ্গেও মিশতে চায়নি, যেমনটি সাধারণত ঘটে থাকে।
এ অংশ পাখির জিনোমের মাত্র দুই শতাংশ জুড়ে আছে, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন, বেশিরভাগ পাখিকে দুটি মূল বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে ফ্লেমিঙ্গো ও ঘুঘু, যাদেরকে ‘বিবর্তন সূত্রে কাজিন’ বলে আখ্যা দিয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট সায়েন্সডেইলি।
পাখির নির্ভুল ‘ফ্যামিলি ট্রি’তেও তাদের জিনোম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে পাখিদের চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। আর ফ্লেমিঙ্গো ও ঘুঘু আগের হিসাবে ছিল ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়’ হিসাবে।
“পাখির বিবর্তনের সমস্যা নিয়ে আমি যতটা চিন্তা করতে চাই, এর জন্য তার চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে আমার ল্যাব,” বলেন এ গবেষণাপত্রের জ্যেষ্ঠ লেখক ও ‘ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা’র জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এডওয়ার্ড ব্রাউন।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পেয়েছে পিয়ার রিভিউড জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এ।
“আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে, জিনোমের একটি বড় অংশ থাকতে পারে, যা অস্বাভাবিকরকম আচরণ করবে। আমরা এই জায়গাটিতেই হোঁচট খেয়েছি।”
‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া স্যান দিয়েগো’র কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সিভাশ মিররাবের নেতৃত্বাধীন এ গবেষণায় এক আন্তর্জাতিক গবেষণা দলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন ড. ব্রাউন।
গবেষকরা বলছেন, ডিএনএ’র আঠালো অংশ পাখি বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাসে বিকৃতি ঘটিয়েছে। এ ছাড়া, ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি যৌথ গবেষণায় অবদান রেখেছিলেন মিররাব ও ব্রাউন, যা মূলত পাখির আপডেট করা ‘ফ্যামিলি ট্রি’র প্রকৃত রূপরেখা সম্পর্কে ধারণা দেয়। আর এ গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেন’-এর জোসেফিন স্টিলার।
উভয় গবেষণাপত্রই ‘ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি’র গুওজি ঝাং, ‘রকফেলার ইউনিভার্সিটি’র এরিখ জার্ভিস ও ‘ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেন’-এর টম গিলবার্টের নেতৃত্বাধীন ‘বি১০কে এভিয়ান জিনোমিক্স’ প্রকল্পের অংশ।
এক দশক আগে ‘নিওভস’ শ্রেণির পাখিদের একটি ‘ফ্যামিলি ট্রি বানিয়েছিলেন ব্রাউন ও তার সহযোগীরা। এটি এমন এক দল, যেখানে বেশিরভাগ পাখির প্রজাতি উপস্থিত।
গবেষণায় ৪৮টি প্রজাতির জিনোমের ভিত্তিতে নিওভ’কে দুটি বড় শ্রেণিতে ভাগ করেছেন গবেষকরা। এক দলে ঘুঘু ও ফ্লেমিঙ্গো। আর বাকিরা অন্য দলে।
আর এ বছর পাখির ৩৬৩টি প্রজাতির ওপর চালানো একই ধরনের বিশ্লেষণের পুনরাবৃত্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এটি, যেখানে একটি ভিন্ন ‘ফ্যামিলি ট্রি’তে ঘুঘু ও ফ্লেমিঙ্গোকে দুটি স্বতন্ত্র দলে রাখা হয়েছে।
এমন দুটি ভিন্ন ফ্যামিলি ট্রি হাতে বিজ্ঞানীদের সামনে ধাঁধাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এর মধ্যে কোনটি সঠিক।
“যখন আমরা বিভিন্ন একক জিন ও এইসব পাখি কোন ‘ফ্যামিলি ট্রি’কে সমর্থন করছে, তা পরীক্ষা করে দেখেছি , তখন হঠাৎ করে দেখা গেল, পুরনো ‘ফ্যামিলি ট্রি’কে সমর্থন করা জিনগুলো সব একই জায়গাতেই আছে। আর এখান থেকেই পুরো বিষয়টি শুরু হয়,” বলেছেন ব্রাউন।
সে জায়গা অনুসন্ধান করে ব্রাউনের গবেষণা দল লক্ষ্য করেছে, লাখ লাখ বছর ধরে এদের মধ্যে যতটা যৌন প্রজনন হওয়া উচিৎ ছিল, ততটা হয়নি। মানুষের মতো, পাখিদের ক্ষেত্রেও বাবা ও মায়ের জিন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে, শুক্রাণু ও ডিম তৈরির জন্য পাখিরা মানুষের মতোই প্রথমে মা-বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিভিন্ন জিনের সঙ্গে মেশে। আর এ প্রক্রিয়াটি ‘রিকম্বিনেশন’ নামে পরিচিত, যার মাধ্যমে কোনও প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সেগুলো পুরোপুরি ভাই বোন নয়।
ব্রাউনের গবেষণা দলটি প্রমাণ পেয়েছে, এক পাখির ক্রোমোজোমের অংশ কয়েক লাখ বছর আগে ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়ার সময় এ ‘রিকম্বিনেশন’ প্রক্রিয়াটি এড়িয়ে গেছে। তবে, এ বিলুপ্তির ঘটনা ও বিভিন্ন জিনোম সংশ্লিষ্ট অসঙ্গতির মধ্যে যোগসূত্র আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
তবে এ গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ফ্লেমিঙ্গো ও ঘুঘুর হিমায়িত ডিএনএ খণ্ড দেখতে প্রায় একই রকম। তবে, সামগ্রিক জিনোম বিবেচনায় এটা স্পষ্ট যে, দুই প্রজাতিই দূরের কোনো জিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
“আশ্চর্যের বিষয় হল, সে সময় ‘রিকম্বিনেশন’-এর প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি এ বিশ্লেষণকে বিভ্রান্ত করতে পারে,” বলেছেন ব্রাউন।
“তবে এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঝুঁকি থাকলেও, এর মাধ্যমে ছয় কোটি বছরের বেশি সময়ের ভবিষ্যৎ অনুমানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা খুবই ভালো বিষয়।
আর এ ধরনের রহস্য অন্যান্য জীবের জিনোমেও লুকিয়ে থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে সায়েন্স ডেইলি।
আপনার মতামত জানানঃ