রাজধানীতে যৌন নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশই ১৪-১৬ বছর বয়সী কিশোরী। তাদের অধিকাংশই নিপীড়নের শিকার হয়েছে বিভিন্ন দিনে সকাল সাড়ে ১০টা-১১টার মধ্যে। রাজধানী ঢাকায় গত চার বছরের বেশি সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন যৌন নিপীড়নের ঘটনা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, নিপীড়নের শিকার এসব কিশোরীর বেশির ভাগই কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তান।
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে গবেষণা-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকায় কিশোর বয়সীরাই এখন যৌন নিপীড়নের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে বেশি। তবে থানায় যত অভিযোগ আসে, নিপীড়নের ঘটনা ঘটে তার চেয়ে অনেক বেশি। নির্যাতনের শিকার ৬৬ শতাংশই নিপীড়নের বিষয়ে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে চায় না। নিপীড়নের শিকারদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান ও দায়ীদের রাজনৈতিক প্রভাবসহ বেশকিছু বিষয় এর পেছনে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য চলতি মাসেই ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ: আ স্টাডি অন দ্য কেসেস অব ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন থানায় পাওয়া যৌন নিপীড়নের বিভিন্ন অভিযোগ ও জরিপের ভিত্তিতে গবেষণাটি চালানো হয়।
জরিপে ৯৪ ভুক্তভোগী মেয়ে ও ৫৬ জন ছেলে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আছে ৫০ জন করে। বাকি ৫০ জন পথশিশু। ভুক্তভোগীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশির বা ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশের বয়স ১৪-১৬ বছরের মধ্যে। মোট ভুক্তভোগীর ২০ দশমিক ৬ শতাংশ ১৭-১৮ বছর বয়সী। এর বাইরে ১১-১৩ বছর বয়সী আছে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া ৮-১০ বছর বয়সীদের মধ্যে নির্যাতিতের হার ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এমনকি তিন-পাঁচ মাস বয়সী শিশু নির্যাতনের ঘটনাও রয়েছে, যার হার ১ দশমিক ১ শতাংশ।
গবেষকদের অন্যতম মাভাবিপ্রবির ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইসতিয়াক আহমেদ তালুকদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গবেষণাটি করা হয়েছে মূলত দুটি পদ্ধতিতে। এর মধ্যে কোয়ালেটিভের মধ্যে নির্যাতনের শিকার মেয়েরা এবং কোয়ানটেটিভের মধ্যে ছেলেরা অংশ নিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সম্ভ্রান্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি সিনিয়র সহপাঠীদের মাধ্যমেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। মেয়েরা কিন্তু গুড টাচ ব্যাড টাচটা প্রথমেই শনাক্ত করতে পারে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা বুঝতে পারে সে যৌন হয়রানির শিকার।
এ ধরনের ঘটনার মূল কারণ অভিভাবকহীন হয়ে চলাফেরা করা। অভিভাবক যে শুধু বাবা-মাই হবেন, সেটা না। একজন নিকট-প্রতিবেশী, একজন চৌকিদার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অভিভাবক হতে পারেন। আর কিশোরীদের যৌন হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘটে থাকে। এর বড় কারণ হচ্ছে, গার্মেন্টে অনেক কিশোরী চাকরি করেন। সেখানে এই সময়টাই শিফট চেঞ্জ বা বিরতি থাকে। এজন্য এ সময়টাতেই এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে।’
প্রতিবেদনে উল্লেখিত নিপীড়নের ঘটনাগুলোর মধ্যে ১২টি ঘটেছে পরিচিতদের মাধ্যমে। নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি। আর পাঁচটি নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে অপরিচিতদের মাধ্যমে। যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে ১০টি ঘটেছে বাড়িতে, যার তিনটিতে জড়িত নিকট আত্মীয়। কোনো কোনো ভুক্তভোগী একাধিকবার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এতে আরো দেখা যায়, রাজধানীতে যৌন নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ৩৪ শতাংশ পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে, বাকি ৬৬ শতাংশই পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের বেশকিছু প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়। সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়, লিঙ্গবৈষম্য, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশের সন্দেহজনক আচরণ ও অভিযুক্ত পক্ষের হুমকির মতো কারণও বড় ভূমিকা রেখেছে।
ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) লিটন কুমার সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজধানীতে যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবসময়ই পুলিশ তৎপর রয়েছে। এ ধরনের অপরাধে যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি জনসাধারণকেও সচেতন ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের যৌন নিপীড়নের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
আপনার মতামত জানানঃ