জনপ্রিয় বিশ্বাস হচ্ছে, গুহামানবেরা পশুর পশম দিয়ে শরীর ঢেকে রাখত। কিন্তু প্রস্তর যুগের মানুষেরা আসলে কী পরতো এবং তারা কীভাবে পোশাক তৈরি করত সে বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো খুব ঝাপসা।
পশম, চামড়া এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ সাধারণত দীর্ঘ দিন সংরক্ষিত থাকে না। বিশেষ করে এক লাখ বছর আগের এমন নিদর্শন পাওয়া যায় না। যাইহোক, গবেষকেরা বলছেন যে মরক্কোর একটি গুহায় পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত এবং মসৃণ করতে ব্যবহৃত ৬২টি হাড়ের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
পোশাক ব্যবহারের প্রথম দিকের একটি প্রমাণ হিসেবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই সরঞ্জামগুলোর বয়স ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার বছরের মধ্যে।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য সায়েন্স অব হিউম্যান হিস্ট্রি-এর প্যান আফ্রিকান ইভল্যুশন রিসার্চ গ্রুপের পোস্ট ডক্টরাল বিজ্ঞানী এমিলি ইউকো হ্যালেট বলেন, আমি প্রাথমিকভাবে মানুষের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য পশুর হাড়ের পরিণতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
যখন আমি প্রায় ১২ হাজার পশুর হাড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলাম। লক্ষ্য করলাম কিছু হাড়ের আকৃতি খুব আলাদা। এটি কোনোভাবেই প্রাকৃতিক আকৃতি নয়। হাড়গুলোর গায়ে খাঁজ বা আঁচড়ের মতো দাগ। আবার ঝকঝকে।
একটি পশুর মাংস খাওয়ার পর হাড়গুলো ফেলে দেওয়ার বদলে মানুষ নিয়মিত ব্যবহার করত। দীর্ঘ ব্যবহারে সেগুলো চকচকে মসৃণ হয়ে যেত। এই হাড়গুলোও তেমন। তবে আকার আকৃতিতে বিশেষ পার্থক্য আছে।
গুহার অন্যান্য হাড়ের গায়ে বিশেষ ধরনের কাটা দাগ দেখা গেছে। ধারণা করা যায়, এখানে বসবাসকারী মানুষেরা মাংসাশী প্রাণী যেমন- বালি শিয়াল, সোনালি খ্যাঁকশিয়াল এবং বনবিড়ালের চামড়া ছাড়াত। মূলত পশমের জন্যই এগুলো সংগ্রহ করা হতো। আর গবাদিপশুর মতো পশুর হাড়গুলোতে যে ধরনের চিহ্ন দেখা গেছে তাতে মনে হয় এগুলো শুধু মাংসের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হতো।
পোশাকের ব্যবহার কখন শুরু হয়েছিল তা হিসাব করে বলা মুশকিল। এটা খুব সম্ভবত প্রাথমিক নিয়ানডারথালদের মতো মানুষ যারা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাস করত, তারা এই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পোশাক পরতো। এটা হোমো সেপিয়েন্সদের আগমনের অনেক আগের ঘটনা। কিন্তু এর সপক্ষে শক্ত প্রমাণ নেই।
উকুনের জিন গবেষণায় দেখা যায়, পোশাকের উকুনের পূর্ব পুরুষ মানুষের মাথার উকুন। আর এরা এই পূর্বপুরুষদের থেকে এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কমপক্ষে ৮৩ হাজার বছর আগে এটি ঘটেছে। সম্ভবত ১ লাখ ৭০ হাজার বছর আগেই তারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এতে ধারণা করা যায়, আফ্রিকার বাইরে ব্যাপকভাবে অভিবাসন শুরুর আগে থেকেই মানুষ পোশাক পরতে শুরু করেছিল।
ড. হ্যালেট বলেন, হাতির হাড় দিয়ে তৈরি ৪ লাখ বছর আগের ৯৮টি সরঞ্জামের মধ্যে একটি সম্প্রতি ইতালিতে আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভব এটি চামড়া মসৃণ করার কাজে ব্যবহৃত হতো। এগুলো নিয়ানডারথালরা ব্যবহার করত বলেই ধারণা করা হয়। ছিদ্রওয়ালা সুচ এরও অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড অনুযায়ী সেটি প্রায় ৪০ হাজার বছর আগের ঘটনা।
ড. হ্যালট মরক্কোতে হাড়ের যে সরঞ্জামগুলো আবিষ্কার করেছেন সেগুলো কিছুটা স্প্যাটুলার (খুন্তি) মতো। এই সরঞ্জাম চামড়ার সংযোগকারী টিস্যু অপসারণের জন্য ব্যবহৃত হতো। হ্যালেট বলেন, একই ধরনের হাড়ের সরঞ্জাম আজও কিছু চামড়া পাটকারী ব্যবহার করেন।
এই ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণ হলো, এগুলো সহজে চামড়ায় বিদ্ধ হয় না। অর্থাৎ চামড়া অক্ষত রেখে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য এমন সরঞ্জামেরই দরকার।
মরক্কোর আটলান্টিক উপকূলে কনট্রেব্যান্ডিয়ার্স গুহায় হাড়ের সরঞ্জামগুলো পাওয়া গেছে। ড. হ্যালেট বলছেন, আজ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার বছর আগের জলবায়ু এখনকার মতোই নরম (চরম ভাবাপন্ন নয়) ছিল। এতে ধারণা করা যায়, প্রাথমিক যুগের পোশাক ছিল মূলত অলংকার এবং কোনো ক্ষেত্রে সুরক্ষার বস্তু। অর্থাৎ প্রস্তর যুগেও ফ্যাশন সচেতন কেউ তাহলে ছিল!
অতীতে বা আজকের দিনে কখনোই এখানে কোনো চরম তাপমাত্রা বা চরম জলবায়ু পরিস্থিতি ছিল না। তাই এখানে পোশাকের সত্যিই কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতা ছিল নাকি প্রতীকী বস্তু অথবা দুটোই এ নিয়ে ধন্দে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিজ্ঞান সাময়িকী আইসায়েন্সে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ