দেশে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। সরকারি, বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময় ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরো অন্তত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রও রয়েছে। মোট সক্ষমতায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হলে চলতি অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ক্যাপাসিটি চার্জের হিসাব বিবেচনায় নিলে বিপিডিবির পক্ষে মূল্য বাড়িয়েও আর্থিক চাপ সামাল দেয়া সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ক্রয়ে গত অর্থবছর বিপিডিবির ব্যয় ছিল ৯৫ হাজার ৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো (প্রাক্কলিত)। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির ব্যয় হয়েছিল ৭১ হাজার ৪৯৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক অর্থবছরের ব্যবধানে সংস্থাটির ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে বিপিডিবিকে।
গত অর্থবছরে বিপিডিবি বেসরকারি (আইপিপি) ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে ৩৪ হাজার ২৫৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে সংস্থাটির অর্থ ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর অর্থ ব্যয় হয়েছিল ৫২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ এক অর্থবছরের ব্যবধানে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কম কেনা হলেও ব্যয়
বেড়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় বাড়ায় বিপিডিবির গড় উৎপাদন ব্যয়ও ৮ টাকা ৮৪ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৩৩ পয়সায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি আমদানি ব্যয়, প্রাক্কলন অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ায় সক্ষমতা অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ—সবগুলোই এ খাতের ভুল পরিকল্পনার মাশুল। সঠিক প্রাক্কলন ও সময় অনুযায়ী সবকিছু না হওয়ায় এ খাতে আর্থিক ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন গণমাধ্যমকেকে বলেন, ‘গোটা বিষয়টি হলো বিদ্যুৎ খাতে ভুল পরিকল্পনার মাশুল। চাহিদা ও সক্ষমতার প্রাক্কলনে ভুল থাকায় আজ ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এখনো বিদ্যুতের চাহিদার যে প্রাক্কলন করছে, সেখানেও সমস্যা রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য না বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে না। দেখা যাচ্ছে, ভর্তুকি কমলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কিন্তু কমবে না। কারণ নতুন বড় অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে।’
বিদ্যুৎ খাতে প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়তে থাকায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হলেও সামগ্রিকভাবে অর্থ সংকট তৈরি হচ্ছে বিপিডিবির। বিপিডিবির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানি আমদানি ও ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে বিপিডিবির ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল ১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬৫৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকেকে বলেন, ‘সরকার বিদ্যুৎ খাতের লোকসান কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। পর্যায়ক্রমে এভাবে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ে আর্থিক পার্থক্য কমানো গেলে এক পর্যায়ে সচ্ছল অবস্থায় ফিরবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক এ ক্ষতি থেকে বিপিডিবিকে বের হতে হলে বিদ্যমান ক্রয়চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। পাশাপাশি পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে। এটি করা গেলে বিপিডিবির বড় আর্থিক সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন বিদ্যুৎ খাতের সাবেক নীতিনির্ধারকরা।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) বি ডি রহমতুল্লাহ গণমাধ্যমকেকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের বৃহৎ এ লোকসান থেকে বের হতে হলে শুরুতেই একপেশে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাতিল করতে হবে। কারণ বিপিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় করুক বা না করুক তাকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে, অন্তত এ ধারাটি এখন বাতিল হওয়া দরকার। এ ধরনের ক্রয়চুক্তির আওতায় বিপিডিবির আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, স্বল্পমেয়াদি যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলো ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্টের’ শর্তে নবায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিপিডিবি এখন চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে ফেলেছে। এসব অসংগতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে বিপিডিবি আগের ধারায় ফিরে আসতে পারবে।’
বিদ্যুতের অযৌক্তিক ব্যয় না কমিয়ে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। তাদের ভাষ্যে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তোলার আগে উৎপাদন ব্যয় কমানোর পথ বের করতে হবে সরকারকে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় না করে বিদ্যুতের ভর্তুকি তুলে দেয়ার জন্য মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ একটা দিতে হবে, কিন্তু সেটি কত টাকা, কীভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, কারা নির্ধারণ করছে সেটির বিষয়ে পরিষ্কার একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার, কিন্তু সেটা নেই। এগুলোর বিষয়ে আগে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসা দরকার।’
বিদ্যুৎ খাতের নতুন বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। পাশাপাশি উচ্চমূল্যের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ প্রত্যেকটি দেশেই রয়েছে। বিনিয়োগের সুরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল বলেই বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এসেছে। বিগত বছরগুলোয় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আমরাও বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে সেগুলো থেকে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্টের’ ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নবায়ন করা হলে সেভাবেই চুক্তিগুলো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুৎ খাতকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে সরকার ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। যে কারণে সীমিত আকারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটি এক পর্যায়ে গিয়ে ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন। তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৭৩টি আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী) ও ৩০টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্র ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ বা রেন্টাল পেমেন্ট) দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ অর্থ পেয়েছে সামিট গ্রুপ, অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইউনাইটেড গ্রুপ, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, বাংলা ট্র্যাক গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ ও কেপিসিএলের (সামিট-ইউনাইটেড) বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
আপনার মতামত জানানঃ