উইলহেলম ভন ওস্টেন পেশায় ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক, যদিও দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটত একটি ঘোড়ার পিছনে। যে সে ঘোড়া নয়, মালিকের মতোই ‘গণিতবিদ’ এই ঘোড়া। তার নাম হান্স। সে নাকি অনায়াসে করতে পারত যোগ-বিয়োগের অঙ্ক। এমনকি মানুষের নামও লিখে দিতে পারত সে।
লোকে তার নাম দিয়েছিল ‘ক্লেভার হান্স’। অবশ্য অবিশ্বাসীরও অভাব ছিল না। অলস্বল্প ম্যাজিকও জানতেন ওস্টেন। দুর্জনেরা বলত, ঘোড়াকে দিয়ে অঙ্ক করানো আসলে সেই জাদুর খেলা। সত্যিটা কী জানতে রীতিমতো প্রদর্শনী আয়োজন করা হল জার্মানিতে।
সেটা ১৯০৪ সালের ঘটনা। সর্বসমক্ষে নিজের প্রতিভা আর ওস্টেনের শিক্ষার প্রমাণ দিতে হাজির হল হান্স। চারদিকে তখন অসংখ্য আগ্রহী মানুষের জমায়েত। ওস্টেন প্রশ্ন ছুঁড়তে লাগলেন একের পর এক। আর ঘোড়াটি মাটিতে পা মেরে উত্তর দিল সঠিক সংখ্যা। যোগ-বিয়োগের পাশাপাশি গুণ-ভাগের অঙ্কও করে দিল সে। তবে শর্ত ছিল, খুব বড়ো সংখ্যার উত্তর যেন না হয়। এরপর এল নাম জিজ্ঞাসার পালা।
ওস্টেন উচ্চারণ করলেন একটি শব্দ। হান্স আবারো মাটিতে পা ঠুকে একে একে বুঝিয়ে দিল প্রতিটি বর্ণমালা। যেমন ‘এ’ অর্থে ১, ‘বি’ অর্থে ২, এভাবে। অবশেষে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন শিক্ষক। মাসের অষ্টম দিন যদি মঙ্গলবার হয়, তাহলে শুক্রবার কত তারিখ হবে? বার্লিনের ব্যস্ত দুপুরকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে ঠিক এগারোবার শোনা গেল ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। হাততালি দিয়ে উঠল মুগ্ধ জনতা।
তারপর বহু জায়গায় প্রদর্শনী দেখাতে লাগল ‘চতুর’ হান্স। তার জনপ্রিয়তা দেখে অন্য কোনো প্রাণী ঈর্ষা করেছিল কিনা বলা মুশকিল, তবে শত্রু বেড়েছিল ওস্টেনের। খবর চলে গেল জার্মানির শিক্ষাদপ্তরের কাছেও। পশুপাখির প্রতিভা নিয়ে মানুষের আগ্রহ চিরকালের। তার উপর একটি প্রাণীর আশ্চর্য কীর্তিকলাপ অবাক করে দিয়েছিল তাদের। তাই একবার সরেজমিনে পরীক্ষা করে দেখা উচিত অবশ্যই।
আর যদি কোনো চালাকি এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তাহলে ভণ্ডামির দায়ে পড়তে হবে ওস্টেনকে। শিক্ষাদপ্তর থেকে নিয়োগ করা হল দার্শনিক ও মনোবিদ কার্ল স্টাম্ফকে। মোট ১৩জন সদস্যকে নিয়ে তৈরি হল ‘হান্স কমিশন’। যার মধ্যে ছিলেন সার্কাসের মালিক, চিড়িয়াখানার প্রধান, স্কুলশিক্ষক-সহ আরো বিভিন্ন পেশার মানুষ। অবশ্য মূল দায়িত্বটা ছিল অস্কার ফাঙ্কস্টের উপর।
১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পরীক্ষা হল হান্সের। দেখা গেল ওস্টেনের উপস্থিতি ছাড়াও অঙ্কের সমাধান করতে পারছে হান্স। ফলে, আর যাই হোক ভণ্ডামির প্রশ্ন ওঠে না। তবে এটাও ঠিক, প্রশ্নকারী যদি উত্তর জেনে প্রশ্ন করে, তাহলে হান্সের সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।
আর যখন প্রশ্নকর্তা নিজেই উত্তর জানে না, তখন মাত্র ৬ শতাংশ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিচ্ছে সে। আবার কিছুটা দূর থেকে প্রশ্ন করা হলেও ব্যর্থ হচ্ছে হান্স। ফাঙ্কস্ট সিদ্ধান্তে এলেন, ঘোড়াটির অঙ্ক করার দাবি সম্পূর্ণ ভুল। সংখ্যা নয়, সে নির্ভর করে থাকে প্রশ্নকর্তার শারীরিক অভিব্যক্তির উপরে।
বিশেষ করে ভরা রাস্তায় প্রদর্শনীর সময় সঠিক উত্তরের কাছে পৌঁছোলে মানুষের মধ্যে যে চাপা উত্তেজনা দেখা যায়, তা অনুভব করতে পারে হান্স। অনেক সময় নির্ভর করে থাকে ওস্টেনের কিছু বিশেষ শিক্ষার উপরেও। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল ফাঙ্কস্টের পরীক্ষার সময়ও।
যদিও ফাঙ্কস্টের তত্ত্ব নিয়েও অনেক মতবিরোধ ছিল সেই সময়ে। ভুল উত্তরের ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তার শারীরিক অভিব্যক্তির কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি তিনি। তাই ফাঁক রয়ে গেছে গবেষণার সেই দিকটিতে। অবশ্য পরবর্তীতে দীর্ঘ চর্চা হয় ‘ক্লেভার হান্স এফেক্ট’ নিয়ে। পশুপাখিদের আচরণ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা হয় এই পদ্ধতি। সে আলাদা কাহিনি। কিন্তু হান্সের কী হল এরপর?
ফাঙ্কস্টের পরীক্ষার ফল সামনে আসার পর কমতে থাকে তার জনপ্রিয়তা। ১৯০৯ সালে ওস্টেনের মৃত্যু পর্যন্ত বেশ কিছু প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলেও, সেই উন্মাদনা আর পেল না হান্স। অবশেষে ১৯১৪-তে মৃত্যু ঘটে তার। ততদিন পর্যন্ত অন্য অনেক মালিকের কাছেই থেকেছে সে। ‘গণিতবিদ’ নয়, আর পাঁচটা ঘোড়ার মতোই কেটেছিল জীবনের শেষ কয়েকটি বছর। সূত্র: প্রহর।
আপনার মতামত জানানঃ