দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকটে অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ ক্রাইসিস কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও কিছুতেই সুফল আসছে না। সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ব্যয়ও বেড়েছে।
ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় টাকার সংকটে পড়েছে সরকার। রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ক্রমেই বাড়তে থাকায় ব্যয় মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধার করছে। এতে বাড়ছে ঋণের বোঝা। এদিকে ঋণের পরিমাণ বাড়লেও বাড়ছে না সরকারের আয়। এতে ঋণ শোধ করা নিয়ে টানাপড়েনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওদিকে বিদেশি ঋণ সহায়তা ও সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের বিনিয়োগ আসছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণের ‘রিফাইন্যান্সিং’ করে সময় বাড়ানো এবং ব্যয় কমানো একটা বিকল্প হতে পারে। এর আগে করোনার সময় থেকে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার টাকার সংকটে পড়েছিল। ওই সময়ে রাজস্ব ঘাটতির টাকা সরকার ঋণ করে মিটিয়েছে।
এখন রাজস্ব আয় ঘাটতির পাশাপাশি ঋণের সংকটও রয়েছে। ঋণ করার মতো যথেষ্ট টাকা ব্যাংকেও নেই। ফলে সরকারের টাকার সংকট বেড়েছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের ধার নেয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। ধার নেয়ার পরিবর্তে উল্টো ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
এই অর্থও পরিশোধ করতে হচ্ছে অর্থব্যবস্থার অন্য খাত থেকে ঋণ নিয়ে। এ ছাড়া ডলার সংকটের মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেয়া কঠিন শর্তের অনেক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। এসব সংকট মেটাতে বিদেশি তহবিল পাওয়ার চেষ্টা করছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ও সরকার। ঋণের সংকটে অনেক প্রকল্পের কাজও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সরকার ডলারের পাশাপাশি টাকা খরচেও ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে।
চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি ২৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হওয়ায় রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়েছে। আয়ে টান পড়লেও ব্যয় কিন্তু থেমে নেই। এতে টান পড়েছে কোষাগারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছরই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়। রাজস্ব আয়ে ঘাটতি হলে ওই টাকা সরকার ঋণ করে মিটিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে সরকারের ঋণের দরজা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যে কারণে আগের মতো এবার আর ঋণ পাচ্ছে না। ফলে সরকারের টাকার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেয়াও সরকারের অন্যতম একটি উৎস। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এ হার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য, সেটা অর্জন হচ্ছে না। ঘাটতি বরাবরই আছে। সামনে সরকারের তহবিলে চাপ বাড়বে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ আগে নিলেও এখন আর নিতে পারছে না। এতে সুদের হার বেশি এবং আইএমএফ এ খাত থেকে ঋণ নেয়া কমাতে বলেছে। এসব মিলে সব খাত থেকেই সরকারের ঋণের দুয়ার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে মানুষের বিনিয়োগের সক্ষমতাও কমে গেছে। ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার যে আয় করেছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। এ মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণাত্মক।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ঋণাত্মক। অর্থাৎ এই ৬ মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার। এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণেই নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যসব খাতেই খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে।
বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে অনুদান। ফলে বৈদেশিক খাতে অর্থের প্রবাহ কমে গেছে। এতে টাকার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিদেশি বাণিজ্য ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটারনাল ডেট জানুয়ারি-জুন ২০২৩ নামে প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮.৯৪ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮২.৯০ বিলিয়ন ডলার। আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৬.০৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের জুনের তুলনায় ২০২৩ সালের জুনে মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩.৬৫ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ৭৬.৬৮ শতাংশ। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৭৯.৩১ ডলার।
শুধু বৈদেশিক ঋণ নয়। অভ্যন্তরীণ নানা উৎসেও ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ’র তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭.৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের পর থেকে গত ১৪ বছরে এটি ৩২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর গত তিন বছরে এটি ৩৩.৬ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে অনুদান কমেছিল ২৩.৭৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৪০ শতাংশ।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ব্যাহত হচ্ছে। একই কারণে সরকারি খাতের আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ডলার সংকট প্রকট হওয়ার বছরে রেকর্ড স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। এতে বছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২২ সাল শেষে এ স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পেয়েছে ২৫.৮০ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে মূল পরিশোধ হয় ৩০.৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর নিট স্বল্পমেয়াদি ঋণ শোধ করা হয়েছে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দুই মাস পর আবারো রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। সবশেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯.৯৪ বিলিয়ন ডলারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে দুটি পথ আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি আয় বাড়ানো। এই আয়ের মধ্যে রয়েছে কর থেকে আয় এবং কর বহির্ভূত আয়। এই আয় বাড়িয়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণকে পরিশোধ করা। একে ‘রিফাইন্যান্সিং’ বলা হয়।
আপনার মতামত জানানঃ