ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি চাইতে বলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিটি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
১৩ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চতুর্থবারের মতো জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সর্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনায় (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ—ইউপিআর) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যাচাই করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে এই পর্যালোচনাকে কাজে লাগাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানাল অ্যামনেস্টি।
বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপ-আঞ্চলিক পরিচালক লিভিয়া স্যাকার্দি বলেন, বাংলাদেশের চতুর্থ ইউপিআর এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশটির মানবাধিকার, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, বিরোধী নেতা, স্বাধীন গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ পদ্ধতিগত আক্রমণের মুখোমুখি। বাংলাদেশের মানবাধিকার রেকর্ড যাচাই এবং কর্তৃপক্ষকে তাদের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা-প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে এই পর্যালোচনা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউপিআর প্রতি চার বছরে একবার সংস্থার সব সদস্যদেশের মানবাধিকার রেকর্ড পর্যালোচনা করে। ইউপিআর ২০০৯, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার রেকর্ড পর্যালোচনা করেছিল।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ইউপিআরের জন্য অ্যামনেস্টির দেওয়া তথ্যে আগের সুপারিশ বাস্তবায়নের মূল্যায়ন করা হয়েছে। তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করাসহ শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকার, অন্যান্য মানবাধিকার (যেমন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘু অধিকার, মৃত্যুদণ্ড, শরণার্থীদের অধিকার) সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি বলেছে, ২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সর্বশেষ ইউপিআর হয়। তখন বাংলাদেশ সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার সুপারিশ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশটি ক্রমাগতভাবে এই অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আইনের বেপরোয়া সংস্কার ও আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এ আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কঠোর বৈশিষ্ট্যগুলো রাখা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশ সরকারকে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। একই সঙ্গে মানবাধিকারকর্মী, সমালোচক, ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে এই আইন যাতে ব্যবহার করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, আগামী জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারের চর্চা করার জন্য যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের অবিলম্বে, নিঃশর্তে মুক্তি দিতে হবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, গত পাঁচ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম উদ্বেগজনক মাত্রায় অব্যাহত ছিল। যদিও বাংলাদেশ সরকার গত ইউপিআরে এই মানবাধিকার-সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার প্রচেষ্টা বাড়ানোর সুপারিশ সমর্থন করেছিল। তখন থেকে র্যাবের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার একটি সুস্পষ্ট ধরন তদন্ত ও নথিভুক্ত করে অ্যামনেস্টি। ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে র্যাব কমপক্ষে ৪৬৬ জনকে হত্যা করে বলে জানা যায়।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে গুম থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদন করা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের অনুরোধ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের, বিশেষ করে র্যাবের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ অবিলম্বে, পুঙ্খানুপুঙ্খ, নিরপেক্ষ, স্বাধীন, কার্যকর ও স্বচ্ছভাবে তদন্ত করতে হবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুলশিক্ষার্থী, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। কর্তৃপক্ষ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট, লাঠি, সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান ও কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই অবিলম্বে, পুঙ্খানুপুঙ্খ, নিরপেক্ষ, কার্যকর ও স্বচ্ছভাবে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের তদন্ত করতে হবে। আদেশের দায়-দায়িত্বসহ সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অবিলম্বে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক সবাইকে মুক্তি দিতে হবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে তারা। এই সময়ে ৯১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেখা যায়, অন্তত দুই ব্যক্তির মাথার ওপর মৃত্যুদণ্ড রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ড লঙ্ঘন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
যদিও বেশির ভাগ ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে ধর্ষণ, মাদক রাখার মতো অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা রয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আসামিদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে চলছেন। ট্রাইব্যুনালের যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবের বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড অবশ্যই ‘সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের’ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এই সাজা পুরোপুরি বিলোপের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ওপর একটি সরকারি স্থগিতাদেশ দিতে হবে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, ২০১৯ সাল থেকে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে পাঁচটি সুপরিকল্পিত বড় ধরনের হামলা হয়েছে। দৃশ্যত হামলাগুলো ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের প্রতিক্রিয়ায়। এই পোস্টের অধিকাংশই পরে ভুয়া বলে দেখা গেছে। সাধারণভাবে এই হামলায় লুটপাট ও সহিংস ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে।
অ্যামনেস্টি আরও বলেছে, বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি সইয়ের ২৫ বছর কেটে গেছে। তা সত্ত্বেও এই চুক্তি লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তহবিল কমে যাওয়া, শরণার্থীশিবিরের নিরাপত্তা ভেঙে পড়া বাংলাদেশে এই সম্প্রদায়ের জন্য আরও মানসিক ও শারীরিক আঘাতের কারণ হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি নীতি গ্রহণ করা।
বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপ-আঞ্চলিক পরিচালক লিভিয়া স্যাকার্দি বলেন, তাঁর সংস্থা জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনায় যুক্ত হওয়ার জন্য জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছে।
অতীতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তার অগ্রগতি যাচাই করতে বলছে অ্যামনেস্টি। এ ছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোকে নতুন করে আরও সুস্পষ্ট সুপারিশ করার আহ্বান জানায় তারা।
আপনার মতামত জানানঃ