আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সম্ভবত ন্যাটোর সঙ্গেও জোটবদ্ধ হতে চান তিনি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, রাজধানী ইরেভানে বিক্ষোভ সমাবেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করেন তিনি। কিন্তু ওয়াশিংটনের সঙ্গে আর্মেনিয়ার কোনো চুক্তি হোক, সেটা হতে দিতে চায় না মস্কো।
প্রায় ৩০ লাখ মানুষের দেশ আর্মেনিয়া। আজারবাইজান, তুরস্ক, ইরান ও জর্জিয়ার দেশটির চারপাশ ঘিরে আছে। তুরস্ক ঐতিহাসিকভাবে আর্মেনিয়ার শত্রুদেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলের জাতিগতভাবে আর্মেনীয় ও ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে। এর জন্য আজারবাইজাইনের সঙ্গে আর্মেনিয়ার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে আর্মেনিয়ার জন্য বড় ধরনের সমর্থনই রয়েছে। এর পেছনে বিশেষ কারণ হলো, তুরস্ক দুই দফায় (১৮৯৪-১৮৯৬ এবং ১৯১৫-১৯১৮) আর্মেনীয়দের ওপর গণহত্যা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রায় চার লাখ আর্মেনীয় ভিন্নমতাবলম্বী বাস করেন।
নাগোরনো-কারাবাখ দক্ষিণ ককেশাসের বিরোধপূর্ণ এলাকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে এটি আজারবাইজানের অংশ ছিল। কিন্তু আর্মেনিয়া নাগোরনো-কারাবাখকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান দুটিই সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র।
সেখানকার অধিকাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিহীন আর্টশাখ প্রজাতন্ত্রের (নাগোরনো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্র নামেও পরিচিত)। প্রথম নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধের ফসল হিসেবে এর জন্ম।
১৯৯৪ সালে এই যুদ্ধ শেষ হয়। আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলের জাতিগতভাবে আজেরিসদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানোর অভিযোগ রয়েছে। সেখানকার বাড়িঘর, কৃষিখামার, মসজিদ—এমনকি কবরস্থান ধ্বংস করে তারা। হাজার হাজার স্থানীয় মুসলমানকে দেশছাড়া করে।
আজারবাইজানের স্বার্থের সূত্র ধরেই নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে রাশিয়ানদের অবস্থানের কারণ রয়েছে। আর্মেনিয়াতে যদি যুক্তরাষ্ট্র কোনো সেনাঘাঁটি তৈরি করতে যায়, তাতে প্রধান বাধা তৈরি করবে সেখানে রাশিয়ানদের উপস্থিতি। একইভাবে সেখানে ইরানের স্বার্থও রয়েছে। আর্মেনিয়ায় আমেরিকার সেনাঘাঁটি হলে সরাসরি হুমকিতে পড়বে ইরান।
২০২০ সালেও নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে আজারবাইজান বড় বিজয় পায়। পাশিনিয়ানের নেতৃত্বাধীন আর্মেনিয়ার সরকারের বড় পরাজয়। এ পরাজয়ের জন্য পাশিনিয়ান রাশিয়ার সহযোগিতার ঘাটতিকে দায়ী করেছিল। যদিও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যস্থতায় সমঝোতা মেনে নেন। সমঝোতা অনুযায়ী, লাচিন করিডরে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে নাগোরনো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্রের রাজধানী স্টেপানাকার্টকে সুরক্ষা দেওয়া যায়।
সম্প্রতি আজারবাইজান কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, আর্মেনীয় বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে আজারবাইজানের সামরিক অবস্থান লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। তারা এই অভিযানের নাম দিয়েছে আজারবাইজানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান। আর্মেনিয়া আবারও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি তীব্রভাবে অস্থিতিশীল রয়ে গেছে।
২০ সেপ্টেম্বর নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে রাশিয়ার শান্তিরক্ষীদের একটি দলের ওপর ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়। দলটির সবাই নিহত হন। এটি স্পষ্টত রাশিয়ানদের উদ্দেশে প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড। এই গুলির সঙ্গে সেখানকার আর্মেনীয়পন্থীরা জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। এ ঘটনায় রাশিয়া ও আজারবাইজান যৌথ তদন্ত শুরু করেছে।
রুশ ও ইউরোপীয় বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নতুন এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কারণ হলো, তিনি নাগোরনো-কারাবাখ থেকে রাশিয়ানদের তাড়াতে চান। নিদেনপক্ষে রাশিয়ানদের দুর্ভোগে ফেলতে চান।
অস্ত্রবিরতির শর্তের মধ্যে রয়েছে নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনিয়াপন্থী যোদ্ধারা অস্ত্রসমর্পণ করবেন। বাস্তবে ঘটবে কি না, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি।
নাগোরনো-কারাবাখে সামনের দিনে রাশিয়ান শান্তিরক্ষীরা থাকবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্মেনিয়ার প্রেম যেভাবে উথলে উঠছে, তাতে রাশিয়ানদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।
নিকোল পাশিনিয়ান আর্মেনিয়া-আজারবাইজান বিরোধে এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ওয়াশিংটন সেই আহ্বানে সাড়া না দিলেও রাশিয়া ও অন্যদের মতো নতুন করে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ায় নিন্দা জানিয়েছে।
আজারবাইজানের স্বার্থের সূত্র ধরেই নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে রাশিয়ানদের অবস্থানের কারণ রয়েছে। আর্মেনিয়াতে যদি যুক্তরাষ্ট্র কোনো সেনাঘাঁটি তৈরি করতে যায়, তাতে প্রধান বাধা তৈরি করবে সেখানে রাশিয়ানদের উপস্থিতি। একইভাবে সেখানে ইরানের স্বার্থও রয়েছে। আর্মেনিয়ায় আমেরিকার সেনাঘাঁটি হলে সরাসরি হুমকিতে পড়বে ইরান।
এখন রাশিয়া যদি ইরানের ওপর নির্ভর করে নাগোরনো-কারাবাখ থেকে সরে যায়, তাহলে সেটা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোক্ষম এক সুযোগ। যুক্তরাষ্ট্র যদি আর্মেনিয়ায় সেনাঘাঁটি স্থাপন করতে চায়, তাহলে রাশিয়া কী নিশ্চুপ বসে থাকবে?
আর্মেনিয়া ভালো করেই রাশিয়ার প্রভাববলয়ে থাকা দেশ। এ ছাড়া ইউক্রেন, ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যেভাবে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে তৎপর, সেটা রাশিয়ার জন্য সতর্কবার্তা।
গবেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে যদি তার বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখতে হয়, তাহলে ইউরেশিয়া অঞ্চলকে হাতে রাখতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র আবারও জর্জিয়া, উজবেকিস্তান কিংবা অন্য যেকোনো অঞ্চলে (আর্মেনিয়া) মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে।
নিকোল পাশিনিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সমর্থন ও সহযোগিতা চাইছেন। একই সঙ্গে তিনি নাগোরনো-কারাবাখে পরাজয়ের জন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করছেন। পাশিনিয়ান এই কৌশলের প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন। রাশিয়া আবার সেটা চুপ করে সহ্য করবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র কি আর্মেনিয়াতে সেনা মোতায়েন করবে? রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
আপনার মতামত জানানঃ