স্কুলছাত্রীর নিখোঁজের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা দায়ের হয়। এতে পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করেন। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল যে, তারা ধর্ষণ ও হত্যার পর লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর নিখোঁজ স্কুলছাত্রী ফিরে আসলে ঘটনা ভিন্ন রুপ নিতে থাকে। জানা যায় আসলে ধর্ষণ ও হত্যার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তবে প্রশ্ন ওঠে আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নিয়ে। জীবিত স্কুলছাত্রীকে হত্যা করা নিয়ে আসামীদের স্বীকারোক্তির বিষয়ে বিচারিক তদন্ত করেন নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট । গত সোমবার(৪ জানু) মামলায় আসামীদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত সদর থানার কার্যক্রমের বিষয়ে বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ তিন আসামীকে মারধর ও ভয় দেখিয়ে জবানবন্দী আদায় করেছিল।
মামলার এজাহার, সাক্ষীদের জবানবন্দী, আসামীদের বানবন্দী ও ভিকটিমের জবানবন্দী পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানা ফেরদৌস। রিপোর্টে নির্যাতন করে জবানবন্দী আদায়ের বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার(৫ জানু) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চে এ রিপোর্টের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামিনের আশ্বাস দিয়ে পুলিশ আসামীদের আদালতে স্বীকোরোক্তিতে কী বলতে হবে তা শিখিয়ে দিয়েছে। এ কারণে পুলিশের শেখানো কথা আদালতে স্বীকারোক্তি হিসেবে বলেছেন বলে আসামীরা জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ভয়ভীতি দেখিয়ে ও মারধর করে কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করার স্বীকারোক্তি নেয় পুলিশ।
জানা যায়, গত বছরের ৪ জুলাই ১৫ বছর বয়সী কিশোরী নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। পরিবারের লোকজন তাকে না পেয়ে থানায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও পরে মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ আবদুল্লাহ, রকিব ও খলিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেন। তারা কিশোরীকে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা গত ৯ আগস্ট আদালতে দেওয়া জবানবন্দীতে স্বীকার করেন। ঘটনার ৪৯ দিন পর গত ২৩ আগস্ট ওই কিশোরী ফিরে আসে। কিশোরী আদালতকে জানায়, ইকবাল নামের এক যুবককে বিয়ে করে বন্দর এলাকার এক ভাড়া বাড়িতে সংসার করছে সে।
এরপর গত ২৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে কথিত ধর্ষণ ও হত্যার শিকার স্কুলছাত্রীর জীবিত ফেরত আসার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
গত ২৫ আগস্ট ওই স্কুলছাত্রী ফিরে আসার ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করা হয়। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঁচ আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির এই আবেদনটি দাখিল করেন।
রিভিশন আবেদনে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা এবং যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া ওই মামলার নথি তলবেরও আবেদন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, মূল মামলার বাদী এবং আসামিদের বিবাদী করা হয়।
গত ২৪ আগস্ট ‘ধর্ষণের পর নদীতে লাশ ফেলে দেয়া স্কুলছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সেই প্রতিবেদন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। তখন আদালত লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেন। এর পরের দিন একটি রিভিশন মামলা করা হয়।
ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করে শিশির মনির জানান, গত ৪ জুলাই ৫ম শ্রেণির ছাত্রী দিসা নিখোঁজ হয়। গত ৬ আগস্ট নিখোঁজ স্কুলছাত্রী দিসার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। স্বীকারোক্তিতে তারা জানান, তারা স্কুলছাত্রী দিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেন। জবানবন্দি গ্রহণের পর আসামিদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু গত ২৩ আগস্ট দিসাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশ হেফাজতে। দিসা ফেরত আসায় ধর্ষণ ও হত্যা বিষয়ে আসামীদের দেয়া স্বীকারোক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এরপর ২৭ আগস্ট জীবিত থাকার পরও নারায়ণগঞ্জের স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগের দায়ের করা মামলায় আসামীদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত সদর থানার কার্যক্রমের বৈধতা ও যৌক্তিকতার প্রশ্নে মামলার সব নথি তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ওই মামলায় তদন্তের সঙ্গে জড়িত দুই তদন্ত কর্মকর্তাকেও তলব করেছিলেন আদালত। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় তারা হাজির হয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে ব্যাখ্যা দেন।
এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ জীবিত থাকার পরও নারায়ণগঞ্জের স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় আসামীদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত সদর থানার কার্যক্রমের বিষয়ে বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এই প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে নির্দেশের ধারাবাহিকতায় ৪ জানুয়ারি সোমবার হাইকোর্টে সিলগালা করে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনে সত্যতা নিশ্চিত করে যে, তিন আসামীকে মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করা হয়। আর এই কাজটি করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই শামীম আল মামুন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রিমান্ডের নামে পুলিশের নির্যাতন থানাগুলোকে নরকে পরিণত করেছে। রিমান্ডের নামে পুলিশের নির্যাতন কতটা ভয়াবহ হলে একজন লোক স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে অপরাধ সংঘটিতই হয় নাই, সেটা সে করেছে। কেবল নারায়ণগঞ্জের থানার নয়, দেশের সবকটা থানার চিত্রটা একই রকম। থানার ভেতরে রিমান্ডের নামে আসলে টর্চার সেল পরিচালনা করে থাকেন পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। জিজ্ঞাসাবাদের নামে আদালতে রায়ের আগেই অভিযুক্তকে যে শাস্তি ভোগ করতে হয়, তারা মনে করেন, আদালত কৃতকর্মের জন্য আসামীকে শাস্তি দেওয়ার চেয়েও বড় শাস্তি। কেবল নারায়ণগঞ্জের নয়, দেশের সবকটা থানা থেকে রিমান্ডের নামে এই নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানান সংশ্লিষ্টরা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ