নিরাপদ সড়কের আন্দোলন জোরদার হওয়ায় দাবির মুখে আইন সংশোধন করেছে সরকার। তাতেও কমেনি সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। উল্টো বেড়েই চলেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। নানা কারণে তাতে প্রকৃত চিত্র উঠে না আসায় তথ্যবিভ্রাট দেখা যাচ্ছে।
এমনকি সেটি নিয়েই প্রশ্ন তুলছে খোদ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। আবার সংস্থার পক্ষ থেকে যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে চলতি বছর, তা নিয়েও পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে বেসরকারি সংগঠনগুলো। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য নিয়ে যে হযবরল অবস্থা, তার দায় কার, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে দেশের যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় যানবাহনের চলাচল বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। তাতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে যানবাহনের পরিসংখ্যানের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য থাকার কথা।
কিন্তু তারা সেটি না করায় বেসরকারি সংগঠনগুলো তাদের মতো করে এসব তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার এ বছর বিআরটিএ সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য দেওয়া শুরু করলেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।
তাদের মতে, নিরাপদ সড়কের দাবি জোরদার হওয়ায় বেসরকারি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। এতে সড়ক ও পরিবহন খাত নিয়ে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে।
কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান একেক সংগঠন একেক রকম দেওয়ায় তথ্যে হেরফের হচ্ছে। এই বিভ্রান্তির জন্য মূলত দায়ী বিআরটিএ। তারা সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে পারছে না বা করছে না। বেসরকারি সংগঠনগুলোরও দায় আছে। তবে তাদের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজধানী কিংবা বিভিন্ন মেট্রো এলাকা ছাড়াও দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি যেসব হাসপাতাল রয়েছে, সেসব হাসপাতালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক হয়ে বিআরটিএ কার্যালয়ে পাঠানো হলে দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য উঠে আসবে।
এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা। কারণ, দুর্ঘটনা যেখানে ঘটুক না কেন, উপজেলা, জেলা কিংবা থানা পর্যায়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সবাই চিকিৎসা নিতে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে যায়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে আরও কার্যকরী হওয়ার কথা বলেন তারা।
গত আট বছরের (২০১৫ থেকে ২০২২) সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিবেদনে আট বছরে ৩২ হাজার ১৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৩ হাজার ২২০ জন, আহত হয়েছেন ৫৪ হাজার ৩৮১ জন।
সেভ দ্য রোডের হিসাবে এই সময়ে ১ লাখ ৩০ হাজার ৫০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪০ হাজার ৫২৩ জন, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৩০৮ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, গত ৭ বছরে ৪৪ হাজার ১৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১ হাজার ৬৫৬ জন নিহত ও ১ লাখ ১২ হাজার ৭৫৩ জন আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, গত চার বছরে ২১ হাজার ৬২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৪ হাজার ৬৩৯ জন ও আহত হয়েছেন ৩৪ হাজার ৫৬৫ জন। বিআরটিএ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দিন ও মাসভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তাতে গত ৫ মাসে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৯৭৬। এতে প্রাণহানির সংখ্য ১ হাজার ৯০৪ ও আহত ২ হাজার ৭৯৪ জন।
সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা নিয়ে আগে প্রতিবেদন প্রকাশ করতো না সরকারি সংস্থা বিআরটিএ, যা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো মাস ও বছরভিত্তিক এসব তথ্য-সংবলিত প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করায় তা নিয়ে চাপের মুখে পড়ে।
এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সংস্থাটি। তবে কার্যত বাধ্য হয়ে দায়সারা গোছের হলেও এ বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিআরটিএ, যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এ নিয়ে চলছে সমালোচনাও।
গত মাসের শুরুতে (মে) বিআরটিএর কাছে এপ্রিল মাসের দিনভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতদের তথ্য চেয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে এক চিঠি পাঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
বিআরটিএর পক্ষ থেকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির ঈদযাত্রার প্রতিবেদনকে অবাস্তব ও কাল্পনিক দাবি করে বিস্তারিত তথ্য চেয়েও একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বিআরটিএর প্রতিবেদনের চেয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫১টি, নিহত ৮৯ জন, আহত ৫৫ জন বেশি কেন হয়েছে, ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির চিঠিতে বলা হয়, ‘বিআরটিএ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন তৈরি করে মাসভিত্তিক প্রকাশ করছে। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিআরটিএর প্রতিবেদনের সঙ্গে পুলিশের প্রতিবেদন বা বেসরকারি কোনও সংগঠনের প্রতিবেদনের মিল নেই।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তির কারণ জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) মহাসচিব লিটন এরশাদ বলেন, গণমাধ্যম ও নিজস্ব শাখার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২০১২ সাল থেকে আমরা সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন দিয়ে আসছি। সেকেন্ডারি তথ্যের কারণে এতে একুরেট হিসাবটা বলা দুরূহ ব্যাপার। বেসরকারি সংগঠনের প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিআরটিএ।
কিন্তু তারা সঠিক ও সম্পূর্ণ তথ্য কেন দিচ্ছে না? ২০২৩ সালে এসে তারা কেন প্রতিবেদন দিতে শুরু করেছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের সঙ্গেও তো বিআরটিএর তথ্যের মিল থাকে না। তথ্যের সঠিক চিত্র না পাওয়া গেলে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ১২ বছর ধরে আমরা যে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন প্রকাশ করছি, তার প্রধান সোর্স গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে এবং নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন করা হচ্ছে।
সোর্স হিসেবে নেওয়া গণমাধ্যমের সংখ্যার কম-বেশি থাকায় একেক সংগঠনের তথ্য একেক রকম হচ্ছে। অনেক দুর্ঘটনা গণমাধ্যমে না আসায় সেসব তথ্য আমাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য আসছে।
এ বিষয়ে সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। বিভিন্ন জেলায় থাকা আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি পুলিশের কাছ থেকেও আমরা তথ্য নিয়ে থাকি। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ওপর প্রতিবেদন করে থাকি। কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্যগুলো সংগঠিত না থাকায় সংগঠনগুলোর তথ্যে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, আমরা দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে নিয়ে থাকি। এটি করতে গিয়ে অনেক সময় একই তথ্য একাধিকবার চলে আসছে।
আবার অনেক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য গণমাধ্যমে না আসায় সেই তথ্যও দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া কেন দুর্ঘটনা ঘটলো, হতাহতদের বয়স কত, তাদের লিঙ্গ পরিচয় ইত্যাদি তথ্যও ঠিকভাবে পাওয়া যায় না অনেক সময়। সে কারণে একেক সংগঠনের প্রতিবেদনে একেক রকম তথ্য আসছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫০
আপনার মতামত জানানঃ