“Half of me is beautiful. But you were never sure which half.”
– Ruth Feldman, “Lilith”
দেবী না দানবী তিনি? নাকি তিনি রক্তমাংসেরই মানবী? উত্তর মেলে না। কাহিনি, কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি ইত্যাদিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন তিনি। আজও তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক বিদ্যমান। কারও কাছে তিনি মূর্তিমতী অশুভ। আবার অনেকেই মনে করেন, তিনি নারী স্বাধীনতার প্রথম সৈনিক। তাঁর নাম লিলিথ। তাঁর খোঁজ পেতে গেলে পাড়ি দিতে হবে সুদূর অতীতে। সেই মেসোপটেমীয় বা ইহুদি পুরাণসমূহ রচনার কালে। চলুন আজ খুঁজে দেখা যাক।
বাইবেল এবং গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, আদমের প্রথম স্ত্রী এবং ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রথম নারী ছিলেন ইভ নয়, লিলিথ। লিলিথকে নিয়ে অনেক রকমের প্রচলিত তথ্য আছে ইন্টারনেটে। উইকি ঘাটলেই পেয়ে যাবেন প্রমাণ সহ আরো অন্যান্য তথ্য।
কিন্তু আসলেই কে ছিলেন এই লিলিথ, জেনে নেওয়া যাক সংক্ষেপে। বাইবেল অনুযায়ী লিলিথ ছিলেন আদমের প্রথম স্ত্রী এবং ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রথম নারী এবং শয়তানের প্রথম স্ত্রী। আদম এবং লিলিথকে একই মাটি থেকে বানানো হয়। শুধু তাই না, লিলিথ ছিলো আদমের সমতুল্য। আদমের মত করেই জ্ঞান-বুদ্ধি-চিন্তাশক্তি লিলিথকে প্রদান করা হয়।
ইহুদি কিংবদন্তি অনুসারে, লিলিথ প্রথম মানব আদমের প্রথমা পত্নী। হিব্রু ‘বাইবেল’-এর ‘বুক অব ইসাইয়া’-য় তাঁর উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলে হয়েছে, ইভের আগে লিলিথই ছিলেন আদমের স্ত্রী। কিন্তু আদমের আনুগত্য স্বীকার না করায় ঈশ্বর তাঁকে স্বর্গোদ্যান থেকে বিতাড়িত করেন।
লিলিথ নিজেই আদমকে ছেড়ে চলে আসেন। এর কারণ হিসাবে বলা হয়, যেহেতু তারা সমান সমান ছিলেন তাই একে অন্যকে একেবারেই সহ্য করতে পারছিলেন না। আর তাই লিলিথ আদমকে ছেড়ে আসলে, আদমের সহচারী হিসাবে পরবর্তীতে ইভ -কে বানানো হয়। এবং এইবার ইভের জন্য ঈশ্বর অন্য মাটি এবং বুদ্ধি-জ্ঞান কিছুটা পরিবর্তন আনেন।
‘বাইবেল’-এর ‘জেনেসিস’ অধ্যায়ে লিখিত আছে যে, ঈশ্বর আদমের পাঁজর থেকে ইভকে তৈরি করেছিলেন। আর আদম নির্মিত হয়েছিলেন মাটির দ্বারা। ইহুদি কিংবদন্তি জানায়, লিলিথকেও ঈশ্বর সেই মাটি দিয়েই তৈরি করেন, যা থেকে আদম নির্মিত হয়েছিলেন। অনেক কিংবদন্তি আবার এ কথাও বলে যে, লিলিথকে নির্মাণের সময়ে ঈশ্বর মাটির সঙ্গে কিছু ময়লাও মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
লিলিথ আদমকে ছেড়ে চলে গেলেও ঈশ্বর লিলিথকে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনজন ফেরেশতা পাঠান। তারা পৃথিবীতে মিশরের কাছে লিলিথকে দেখতে পান। যেখানে তিনি তাঁর কন্যাকে জন্ম দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ফেরেশতাদেরকে লিলিথ বলে দেন যে তিনি ফিরবেন না। এতে ঈশ্বর রেগে যান এবং চিরতরে লিলিথকে বহিষ্কার করেন।
লিলিথ পরবর্তীতে একটি গুহায় বাস করতে শুরু করেন, যেখানে আয়নার সাহায্যে তিনি আদম এবং ইভকে দেখতে পেতেন। লিলিথের কন্যা এই বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে গুহার অনেক ভিতরে গিয়ে আয়নাটি রেখে আসেন। সেখান থেকে শয়তান লিলিথকে দেখে তাঁর প্রেমে পরে এবং তাঁর সাথে যোগাযোগ করে। এরপর লিলিথ প্রায় শ’খানেক মেয়ে এবং ছেলে জন্ম দেন।
লিলিথের প্রতি ঈশ্বর এতটাই বিরূপ ছিলেন যে, তাকে এবং তাঁর সমস্ত সন্তানকে তিনি অভিশপ্ত করে দেন। লিলিথ কে নিয়ে আরো অনেক বর্ননা পাওয়া যায় –
“লিলিথ এর আরবী মানে হচ্ছে রাত। এবং তাকে রাতের পিশাচদের মধ্যে অন্যতম একজন বলে মনে করা হয়। লিলিথের যে সকল মুর্তি পাওয়া যায়, সেখানে তাকে পাখা এবং পেঁচার পা যুক্ত অবস্থায় দেখা যায়। ব্যাবেলীয়ন লেখাগুলোতে লিলিথকে উল্লেখ করা হয়েছে অশুভ আত্মা হিসেবে, যে কিনা ছোট ছোট বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে যায়।”
আধুনিক ইহুদিগণ লিলিথকে মর্ডান নারী হিসাবে গণ্য করেন, যে তাঁর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সংসার ত্যাগী এবং জরায়ু স্বাধীনতা স্থাপনকারী।
লিলিথকে নিয়ে মত বিরোধের কোনো শেষ নেই। তাকে শয়তান বলেন বা হাজার শয়তানের জন্মদাত্রী বলেন অথবা স্বাধীন নারীদের প্রতীক বলেন, লিলিথকে এক রহস্য।
অন্য দিকে আবার, প্রাচীন সুমেরিয়ার ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যে লিলিথের উল্লেখ রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবতারে। সেখানে লিলিথ প্রেম, যুদ্ধ, সৌন্দর্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা, ন্যায়বিচার এবং যৌনতার দেবী ইনান্না বা ইসথারের সহচরী হিসেবে বর্ণিত।
লিলিথের যে রূপগুলি প্রত্ন-নিদর্শন থেকে পাওয়া গিয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, তিনি সুন্দরী, নগ্ন এবং তাঁর হাতে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে একটি দণ্ড বিরাজ করছে। অনেক মূর্তিতে লিলিথের সঙ্গে ‘আনজু’ নামে এক বিশেষ পাখিকে দেখা যায়। মেসোপটেমীয় কিংবদন্তি অনুসারে, ‘আনজু’ বা ‘জু’ আধা সিংহ-আধা পাখি-জাতীয় এক কল্পিত প্রাণী।
সুমেরিয়ার প্রাচীন সাহিত্য ‘গিলগামেশ’ থেকে জানা যায়, ইনান্না বা ইসথার তাঁর নিজস্ব উদ্যানে একটি উইলো বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। সেই গাছের কাঠ দিয়ে এক জাদু-সিংহাসন নির্মাণ করবেন, এমনই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু গাছটি কাটতে গিয়ে ইনান্না দেখেন, তার ভিতরে একটি সাপ, তার শাখায় একটি আনজু বা জু পাখি এবং ‘অন্ধকারের কুমারী’ (সম্ভবত লিলিথ) অবস্থান করছে। ইনান্না তাঁর জাদুশক্তি দিয়ে এদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। বীর গিলগামেশ সাপটিকে হত্যা করেন। এবং লিলিথ উড়ে পালিয়ে যান (সম্ভবত আনজু-র পিঠে চড়ে)। লিলিথের বেশ কিছু মূর্তিতে তাই আনজু-কে দেখা যায়।
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, লিলিথ শয়তানের দোসর। শয়তানের সঙ্গে তাঁর মিলনের ফলে জিনদের জন্ম হয়। সৃষ্টিকর্তা প্রতি দিনই বেশ কিছু অশুভ শক্তিসম্পন্ন জিনকে হত্যা করেন। এর প্রতিশোধ নিতে লিলিথও আদমের সন্তানদের, অর্থাৎ সদ্যোজাত মানবশিশুদের (বিশেষ করে পুত্রসন্তানদের) প্রতি রাতে হত্যা করেন।
লিলিথের কাহিনি থেকে পরবর্তী কালে এক অন্য ‘সত্য’-কে তুলে আনেন মানবীচেতনাবাদী গবেষকরা। তাঁদের মতে লিলিথ পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের একতরফা অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। তিনি একই সঙ্গে ঈশ্বর ও আদমের আনুগত্য অস্বীকার করে নারীর স্বাতন্ত্র্যকে ব্যক্ত করেছিলেন।
বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে লিলিথের অশুভত্বের অপবাদ-আবিষ্ট নির্বাসিত জীবনের প্রতিফলন দেখতে পাই বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী নারীদের ভেতর। লিলিথের মতো আত্মমর্যদাকামী নারীদের একইভাবে সমাজ-বিচ্ছিন্ন করে ফেলার অপপ্রয়াস অব্যাহতভাবে বিদ্যমান। আজো শত-সহস্র বছর পরেও দেশে-দেশে নারী তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ব্যাপৃত। আজো সন্তান ও সম্পদের অধিকারের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, নারীর সম্মান অথবা অসম্মান এখনো তার কর্মপরিসর বা ব্যক্তিত্বের প্রভাব সঞ্চারণের উপর নির্ভর করে না।
আজো সমাজ-পরিপার্শ্বের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রপঞ্চে ঘুরপাক খাচ্ছে নারীর অবয়ব। স্বেচ্ছা নির্বাসিত মোহমুক্ত লিলিথের আত্মমর্যাদাবোধ তাই আজকের দ্বিধা বিভক্ত, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন নারীবাদী ভাবনার যোগ্য আদর্শিক প্রতিমুর্তি হয়ে উঠতে পারে। তাই ‘লিলিথ’ বিষয়টিতে আরও অধিক গবেষণা, যথার্থ অনুসন্ধান ও পুনঃপাঠ হওয়া জরুরী।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ