পৃথিবী সৃষ্টির পর যেসব প্রাণী এই গ্রহে অবাধে বিচরণ করত, তার মধ্যে সবচেয়ে সফল প্রাণীর নাম ডাইনোসর। প্রায় ১৪ কোটি বছর ধরে দানবীয় এই প্রাণীটির বিভিন্ন প্রজাতি পৃথিবীজুড়ে একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল; কিন্তু পৃথিবীর ওপর এক বিশাল গ্রহাণু আছড়ে পড়ায় ডাইনোসররা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও, এই দুর্ঘটনার কারণেই সাপ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই মহাবিপর্যয়-পরবর্তী বিশ্বে হাতে-গোনা অল্প কিছু প্রজাতির সাপ বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের ছিল অসাধারণ দুটি দক্ষতা। যথা মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এবং কোনো ধরনের খাদ্য ছাড়াই দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার ক্ষমতা।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সাপ অত্যন্ত সফল একটি প্রাণী। এখন পর্যন্ত যতো দূর জানা যায়, সাপের সর্বমোট ১৫টি পরিবার, ৪৫৬টি গণ, এবং ২ হাজার ৯শ’টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। সুদূর উত্তর গোলার্ধের স্কান্ডিনেভিয়া থেকে দক্ষিণে একেবারে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এদের বসবাসের বিস্তৃতি। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই সাপের উপস্থিতি দেখা যায়। তা হতে পারে সমুদ্রের গভীরতম তলদেশে অথবা পর্বতের সুউচ্চ শানুদেশে প্রায় ষোলো হাজার ফিট ওপরে হিমালয় পর্বতমালাতেও।
এবার ব্রাজিলে খোঁজ মিলল প্রথম চারপেয়ে সাপের ফসিলের। সামুদ্রিক প্রাণী নয়, সাপেদের উদ্ভব ঘটেছে টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ প্রাণীদের বিবতর্নের মাধ্যমেই। ১১ কোটি বছরের পুরনো এই জীবাশ্মের সন্ধানের সঙ্গেই বিবর্তনের বহু বিতর্কিত প্রশ্নের এই পাকাপাকি শিলমোহর পড়ল।
পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেভ মার্টিল বলেন, “টিকটিকি জাতীয় প্রাণীদের থেকেই সাপেদের উদ্ভব ঘটেছে এটা মোটামুটি পরিস্কার। কিন্তু কখন, কিভাবে, কোন ধরণের টিকটিকি থেকে এই বিবর্তন ঘটেছে তা এখনও জানেন না বিজ্ঞানীরা।”
এই ফসিলের সন্ধান উত্তর খুঁজে দিল বহু অজানা প্রশ্নের। এই জীবাশ্ম প্রমাণ করে সামুদ্রিক টিকটিকি নয়, বরং মাটির মধ্যে গর্ত করে থাকা টিকটিকিদের বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভব হয়েছে সাপেদের।
ক্রেটাসিয়াস যুগের এই জীবাশ্মটি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সাপেদের ফসিলের মধ্যে প্রাচীনতম।
টেট্রাপোডোফিস অ্যামপ্লেকটাস নামের এই সাপের যে জীবাশ্মটি পাওয়া গেছে সেটি একটি সাবকের। এর দৈর্ঘ্য মাত্র ২০ সেন্টিমিটার। তবে পূর্ণবয়স টেট্রাপোডোফিস অ্যামপ্লেকটাসের দৈর্ঘ্য এর থেকে অনেক বেশি বলেই ধারণা জীবাশ্মবিদদের।
এই জীবাশ্মের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য দু’জোড়া পায়ের উপস্থিতি। এই ফসিলটির অন্ত্রে কিছু খাদ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে কিছু ভাঙা হাড়ের টুকরোর উপস্থিতিও। এর থেকে বোঝা যায় এই সাপেরা মাংসাশী ছিল।
লেজ বিহীন এই সরীসৃপটির চারটি পা থাকলেও অনান্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে টিকটিকির তুলনায় সাপের মিল অনেক বেশী হওয়ায় বিজ্ঞানীরা একে আদিম সাপ হিসাবেই গণ্য করেছেন। দাঁত এবং দাঁতের সজ্জা একেবাড়েই সাপের মত।
এছাড়া, আবিস্কৃত আরও একটি জীবাশ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবারও সাপের পা থাকার বিষয়টি প্রমাণের চেষ্টা করেছেন একদল গবেষক। তাদেরও দাবি, হারানোর আগে সাপের পা ছিল অন্তত ৭ কোটি বছর। সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন দাবি করেছেন গবেষকরা।
তাদের দাবি, নতুন আবিস্কৃত জীবাশ্মের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, সাপের পেছনের অংশে অর্থাৎ লেজের দিকে পা ছিল।
আর্জেন্টিনার নর্দান পাতাগোনিয়া থেকে গবেষকরা আটটি সাপের মাথার খুলি আবিস্কার করেছেন। এরমধ্যে একটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় ছিল।
আর্জেন্টিনার আজারা ফাউন্ডেশনের (বেসরকারি গবেষণা সংস্থা) গবেষক ফার্নান্দো গার্বেরোগলিও এক বিবৃতিতে বলেন, আমারা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখেছি বর্তমান সাপেদের পূর্বপুরুষেরা ছিল আকারে বৃহৎ। একইসঙ্গে তাদের মুখও ছিল বড়। যদিও আগে সাপের আকৃতি নিয়ে ভিন্ন ধারণা প্রচলিত ছিল। গবেষণায় এও দেখা গেছে যে, পূর্বে বহুদিন ধরে সাপেরা তাদের পেছনে পা ধরে রেখেছিল। কিন্তু বিবর্তনে বদলে গেছে সাপের রূপ। এখন সাপ সম্পূর্ণ পাহীন।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, প্রায় ৭ কোটি বছর ধরে সফল এবং স্থিতিশীল অবস্থায় নাজাশ নামের এক ধরনের সাপ পেছনে পা নিয়ে টিকেছিল। এটা তখন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় এক শারীরিক অঙ্গ হিসেবেই বিবেচিত হতো ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না সাপ পা ছাড়া বাঁচতে অভ্যস্ত হয়েছে।
এ গবেষণার কো-অথর ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার অধ্যাপক মিশেল ক্যাডওয়েল বলেন, এ গবেষণা আধুনিক এবং পুরনো সাপের মাথার খুলির বিবর্তন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হাজির করেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ