ফ্লোরিডার সৈকতে মরা মাছ, নিউ জার্সিতে তিমি, নিউ জিল্যান্ডে স্টার ফিশ আর ক্রে ফিশ ভেসে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ায় নদী আটকে গিয়েছে হাজার হাজার দুর্গন্ধযুক্ত মরা মাছে। পোল্যান্ডে যেন মাছের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বেই সমুদ্র ও মিষ্টি পানির প্রাণীদের গণহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। বিশেষজ্ঞরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে গবেষকরা এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকে উল্লেখ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানিতে শৈবালের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়েছে, যার ফলে মাছ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। আবার পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক প্রাণী তাদের স্বাভাবিক আবাস থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে, যেটিও এই গণমৃত্যুর একটি কারণ। উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজের আনাগোনা বৃদ্ধিসহ জলজ অঞ্চলে মানুষের কার্যক্রম বেড়ে যাওয়াতেও জলজ প্রাণীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
গত বছরে সারাবিশ্বজুড়ে জলজ প্রাণীদের গণমৃত্যু কোথায় কোথায় হয়েছে এবং কেন হয়েছে, তা দেখে নেওয়া যাক। রেড টাইড হিসেবে পরিচিত ক্ষতিকর শৈবালের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব ফ্লোরিডার উপকূলে হাজার হাজার মৃত মাছ ভেসে উঠেছে। গত বছরের গ্রীষ্মেও একই কারণে স্যান ফ্রান্সিসকো উপসাগরে হাজারে হাজারে মৃত মাছ ভেসে উঠেছিল।
এই ক্ষতিকর শৈবাল এতটাই বেড়ে যায় যে পানির রঙ লাল রঙ ধারণ করে। এ কারণেই একে ডাকা হয় রেড টাইড নামে। মহাসাগরে বাতাস চলাচল বেড়ে গেলে সাগরের গভীরে থাকা খণিজ-সমৃদ্ধ পানি ওপরে উঠে আসে। ‘আপওয়েলিং’ নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়ার ফলে শৈবাল জন্ম নেওয়ার এক আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
শৈবালগুলো এমন এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে যেগুলো মাছ মেরে ফেলে, একইসাথে এই বিষাক্ত মাছ খাওয়া সামুদ্রিক পাখিগুলোও মারা যায়। মানুষকেও অসুস্থ করে ফেলতে পারে এই বিষ। পানির নিচে থাকা উদ্ভিদের কাছে সূর্যালোক পৌঁছাতে বাধা দেয় এই শৈবালগুলো, যার ফলে পানিতে অক্সিজেন উৎপাদন কম হয়, মারা যায় মাছ।
এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি আশঙ্কা করছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে এই আপলিফটিংয়ের ‘সময় এবং পরিমাণ’-এ পরিবর্তন ঘটবে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে শৈবাল জন্মানোর হার আরও বেড়ে যাবে। সাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে আরও বেশ কিছু প্রজাতির ক্ষতিকর শৈবাল জন্মানো বেড়ে যাবে। বিষাক্ত নীল-সবুজ শৈবাল গজানোর জন্য গরম তাপমাত্রা পছন্দ করে।
গবেষকরা ধারণা করছেন ঝড়, বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবে, যার ফলে মাটির খণিজ পানিতে চলে আসবে, যা শৈবাল জন্মানোর উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলবে। ক্ষতিকর শৈবালের কারণে কেবল উপকূলীয় এলাকারই ক্ষতি হবে এমন নয়। খরার ফলে সামুদ্রিক শৈবাল মিষ্টি পানিতে চলে আসবে, যা গত কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকবার ঘটেছে। গবেষকরা ধারণা করছেন এই শৈবালের কারণেই নিউ জিল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে হাজারে হাজারে স্টারফিশ আর ক্রেফিশ ভেসে উঠেছে।
ক্ষতিকর শৈবালের এই বিস্তার মানুষের কারণেও হতে পারে। গত বছরে জার্মানি ও পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী ওডেয়া নদীরে ব্যাপকহারে মাছ মারা যায় এক সোনালীরঙা শৈবালের কারণে, যেটি জন্মানোর কারণ হিসেবে নদীতে শিল্প বর্জ্য ফেলানোকে দায়ী করা হয়েছে।
যখন নিউ জিল্যান্ডের উপকূলীয় এলাকায় শত শত ছোট পেঙ্গুইনের মৃতদেহ ভেসে উঠতে শুরু করে তখন স্থানীয় কনজার্ভেশন কর্মকর্তারা জলবায়ু পরিবর্তনকে এর কারণ হিসেবে দায়ী করেন। তাদের মতে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় পেঙ্গুইনগুলো তাদের প্রাকৃতিক আবাস ছেড়ে আরও ঠাণ্ডা এবং গভীর অঞ্চলে যাওয়া শুরু করে, যেটি তাদেরকে বাসা বাঁধা, প্রজনন এবং খাবার আহরণকে আরও কঠিন করে তোলে। একইসাথে গভীর সাগরের শিকারী প্রাণীগুলোর শিকার হয়েছে তারা।
গবেষকদের মতে, অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে থাকা তাসমানিয়া দ্বীপের সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, কারণ একদিকে তারা তীব্র গরমে টিকতে পারছে না, আবার দক্ষিণ সাগরের তীব্র ঠাণ্ডা সহ্য করার মতো ক্ষমতাও নেই তাদের।
তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন গত দশকজুড়ে সী ড্রাগনের জনসংখ্যা ৫৭ শতাংশ কমে গিয়েছে। সী স্টার এবং সী উর্কিনও জনসংখ্যা কমে যাওয়ার শিকার হয়েছে বলে একই গবেষণায় উঠে এসেছে।
গত বছরে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা থেকে অনুমান করা হচ্ছে আগামী তিনশ বছরের মধ্যে সামুদ্রিক প্রাণীদের এক-তৃতীয়াংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মানুষের উৎপাদন করা অতিরিক্ত তাপ মহাসাগরগুলো শোষণ করার ফলে এর পানির তাপমাত্রা বেশ বেড়ে গিয়েছে। গত ষাট বছর ধরে সামুদ্রিক পানির তাপমাত্রা রেকর্ড করা শুরু হয়েছে, এবং এ থেকে দেখা যায় ২০২১ সালের তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যানুযায়ী, নর্থ ক্যারোলাইনা থকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র উপকূলজূড়ে ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসের আগ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি হাম্পব্যাক তিমি এবং সংকটাপন্ন নর্থ আটলান্টিক রাইট তিমির মৃতদেহ ভেসে এসেছে। এছাড়াও নিউ জার্সিতে আটটি ডলফিনের মৃতদেহও সৈকতে উঠে এসেছে।
নিউ জার্সির কর্মকর্তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। একই কারণে খাবারের সন্ধানে উপকূলের কাছাকাছি চলে আসায় জাহাজের সাথে প্রাণীগুলোর সংঘর্ষের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বেশিরভাগ মৃত্যুই হয়েছে জাহাজের সাথে ধাক্কা খেয়ে।
সংরক্ষণ আন্দোলনকারীরা উপকূলীয় অঞ্চলে উইন্ড টারবাইন তৈরিকে দুষলেও সরকারি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন তিমির মৃত্যুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ২০১৬ সাল থেকেই টারবাইন নির্মাণ করা অঞ্চলে অস্বাভাবিক হারে তিমির মৃতদেহ ভেসে এসেছে। গবেষক আর ফেডারেল কর্মকর্তারা পৃথিবীর অন্যতম সংকটাপন্ন সামুদ্রিক প্রজাতি নর্থ আটলান্টিক রাইট তিমি বিলুপ্তিকরণ রোধে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা এখনো জানেন না তিমি বা অন্যান্য প্রাণীগুলোর সৈকতে ভেসে আসার পেছনের কারণগুলো কী। গত বছরে শত শত পাইলট তিমি মাছ নিউ জিল্যান্ডের উপকূলে ভেসে এসেছে। এছাড়াও মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই তাসমানিয়ায় ২০০টি তিমি মারা গিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার নদী আটকে দিয়েছে মৃত মাছের স্তূপ। কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাম্প্রতিক বন্যার ফলে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কয়েক মিলিয়ন মাছ মারা গিয়েছে। তবে অনেক স্থানীয়ই এর কারণ হিসেবে সরকারের পানির অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন।
এক ভিডিওতে দেখা যায়, পানির ওপরে সিলভার মাছের স্তূপ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর এলাকাবাসী পচে২০৫৫ যাওয়া মাছের বাজে গন্ধের জন্য অভিযোগ করছেন।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক প্রাণীর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জয় বেকার জানান বন্যার ফলে নদীতে অনেক ধরনের বিষাক্ত জৈবিক উপাদান ঢুকে গিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কয়েক দিন ধরে পড়া অস্বাভাবিক গরম, যার ফলে নদীতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে অনেকখানি। কর্মকর্তারা জানান, গরম পানিতে বেঁচে থাকতে হলে মাছেদের আরও বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।
বেকার জিজ্ঞাসা করেন, “কেন আমরা এত বেশি বন্য আর এত তাপমাত্রা দেখছি? এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।”
এসডব্লিউএসএস/২০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ