তহবিল সংকটে পড়েছে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো (আইপিপি)। আর এর কারণ বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের অর্থ দেরিতে ছাড় হওয়া। আবার ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আইপিপি উদ্যোক্তাদের। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোর জ্বালানি তেলের মজুদ কমে এসেছে।
খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, আইপিপিগুলোর জ্বালানি তেলের মজুদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত। তবে এটুকুও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারলে এপ্রিল থেকে সারা দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
অথচ এপ্রিলেই দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। তীব্র গরমের কারণে এ সময় আবাসিক ও শিল্পসহ প্রায় সব খাতেই চাহিদা ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়।
কারণ কী?
বর্তমানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) তুলনায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক (এইচএফও) কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কম। এ মুহূর্তে সরকারও এটিকে বিবেচনা করছে ব্যয়সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে। কিন্তু আমদানি করতে না পারায় এখন এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যেও দেখা গেছে দুশ্চিন্তা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারের কাছে আইপিপিগুলোর বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল পাওনা রয়েছে। এ বিল আটকে থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতি মূলধনের সংকটে ভুগতে হচ্ছে।
আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংকের লোকসান হয়েছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ডলার সংকট। এলসি খোলার জন্য চাহিদামাফিক ডলারের জোগান দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
আগে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সহায়তা পাওয়া গেলেও বর্তমানে এ প্রক্রিয়াটিও ধীর হয়ে এসেছে। আইপিপিগুলোর কাছে যে জ্বালানি তেল আছে, তা দিয়ে কোনোমতে মার্চ পর্যন্ত চালানো সম্ভব। আবার সেটুকুও ওই পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করার মতো পর্যাপ্ত নয়। এপ্রিলের জন্য জ্বালানি তেল আমদানি না করা গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। এতে দেশে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বাড়বে।
অর্থ সংকটের কারণে গত বছরের মে মাসের পর থেকেই আইপিপিগুলোর বিল বিলম্বিত হতে শুরু করে। একপর্যায়ে বকেয়া বিল জমতে জমতে সাড়ে ছয় মাসের জমে যায়, যার পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা। যদিও এখন এর পরিমাণ কিছু কমে ১৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিপুল পরিমাণ এ অর্থ বকেয়া থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন চলতি মূলধন সংকটে পড়েছে। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ডলার সংকটের প্রভাবে এলসি খুলতে পারছে না অনেকেই।
এতে করে এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেলের মজুদও কমে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বকেয়া বিল পরিশোধ ও ডলারের প্রাপ্যতা নিশ্চিতের দাবি তুলেছেন বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গত সপ্তাহে সব আইপিপি, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (রেন্টাল) ও সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মূলত বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে সভাটির আয়োজন করা হয়েছিল।
সভায় দেশের বিদ্যুৎ খাতে আসন্ন কঠিন পরিস্থিতির বিষয়টি তুলে ধরে তা মোকাবেলার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করার আশ্বাস দেয়া হয়।
এ সময় সভায় আইপিপিগুলোর গত বছরের জুলাইয়ের পাওনা বিল পরিশোধের তথ্যটিও জানানো হয়। একই সঙ্গে আইপিপিগুলোকে সামনের দিনগুলোয় জ্বালানি তেল আমদানি করে বিদ্যুতের উৎপাদন নিশ্চিতেরও আহ্বান জানানো হয়।
বিপিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান বলেন, ‘হয়তো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না, ১-২ ঘণ্টা বা ৩ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হতে পারে। কিন্তু আমরা আশাবাদী যে সংকট মোকাবেলা করতে পারব।’
বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জ্বালানির ক্রয়সক্ষমতা এখন চ্যালেঞ্জে পড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) এক প্রকাশনায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ার কারণে ২০২২ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বিশ্বের অনেক জায়গায়ই বেড়েছে। বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। এলএনজির দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো এখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৮০ শতাংশই আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। এ গ্যাসের ২০ শতাংশই আবার আসে এলএনজি থেকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
পণ্যটির দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় গত বছর সমস্যায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। এখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। গত বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয়। এতে জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ খাতও সংকটে পড়ে যায়।
ওই সময় দেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ তীব্র হয়ে উঠেছিল। অগ্রাধিকার পেলেও শিল্প খাতে দেখা দেয় বিদ্যুতের সংকট। বিপাকে পড়ে আবাসিক খাতও। আইইএর প্রকাশনায় দেশে গত বছরের মাসভিত্তিক লোডশেডিংয়ের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। আগের বছরের (২০২১ সাল) একই মাসের তুলনায় লোডশেডিং বৃদ্ধির একটি তুলনামূলক চিত্রও এতে দেখা যায়।
আইইএর তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের এপ্রিলে দৈনিক গড় লোডশেডিং বেড়েছে ৭৫০ মেগাওয়াট। এরপর আগস্টে ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত লোডশেডিং হয়েছে গড়ে ৫০০ মেগাওয়াট। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরেও এপ্রিলে বিদ্যুতের চাহিদা ও লোডশেডিং—দুই-ই বেশি থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ সময় এইচএফওভিত্তিক আইপিপিগুলো চাহিদা অনুসারে জ্বালানি তেল আমদানি করতে না পারলে সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ফয়সাল করিম খান বলেন, বর্তমানে আইপিপিগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বকেয়ার পরিমাণ সাড়ে ছয় মাস থেকে কমে পাঁচ মাসে নেমেছে।
ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ডলারের সরবরাহ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। সম্প্রতি বিপিডিবির সঙ্গে হওয়া বৈঠকেও আসন্ন কঠিন পরিস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার কথা বলা হয়েছে। চাহিদামাফিক জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারলে সামনের দিনগুলোয় আমাদের পক্ষ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
বিপিডিবির পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট সক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১১ হাজার ৫২২ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের ৬ হাজার ৩২৯, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের ২ হাজার ৬৯২ ও ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রের ১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২৫৯ ও জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। আমদানি করা হচ্ছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি দিনের বেলায় পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ৯ হাজার ২২০ মেগাওয়াট। আর সান্ধ্যকালীন পিক আওয়ারে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট।
এসডব্লিউএসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ